কিছুদিন আগেও আমাদের জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে ছিল এমন অনেক কিছু, আজ যা হারাতে বসেছে। লেখা তেমনই এক দক্ষতা। আজ মোবাইল-সর্বস্ব জীবনে লেখার অভ্যাসটাই যেতে বসেছে। আমাদের নিজেদেরই অনেক ভেবে বলতে হবে শেষ কবে লিখেছি। মোবাইলের স্ক্রিনে নয়, কাগজ-কলম সহযোগে? আসল কথা হল অভ্যাস। ছোটোবেলায় যে অভ্যাসটা ছিল, আজ আর তাতে শান দেওয়া হয় না। বহু দিন চর্চা না করার ফলে এখন আত্মবিশ্বাসটাই নড়ে গিয়েছে। গবেষণা দীর্ঘদিন ধরে ইঙ্গিত দিয়েছে যে কিবোর্ডে টাইপ করার চেয়ে হাত দিয়ে লেখার সুবিধা অনেক বেশি, বিশেষ করে শিখনের ক্ষেত্রে, কিছু মনে রাখা ক্ষেত্রে বা সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে। সম্প্রতি, নরওয়ের গবেষকরা লেখা এবং টাইপিং উভয়ের সাথে জড়িত অন্তর্নিহিত স্নায়ুর বিন্যাস পর্যবেক্ষণ করে দেখার চেষ্টা করেন ঠিক কেন এমনটি হয়।
নরওয়েজিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির গবেষক অধ্যাপক অড্রে ভ্যান ডার মিরের মতে হাতে লেখার সময়, মস্তিষ্কের সংযোগের প্যাটার্ন কিবোর্ডে টাইপ করে লেখার চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত হয়। এই ধরনের বিস্তৃত মস্তিষ্কের সংযোগ স্মৃতিশক্তি গঠনে এবং নতুন তথ্য আত্মিকরণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তাই শেখার জন্যও উপকারী।
অধ্যয়নের জন্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৬ জন শিক্ষার্থীকে স্ক্রিনে দেখানো বিভিন্ন শব্দ লিখতে বা টাইপ করতে বলা হয়েছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ কাগজ কলমে, কেউ ডিজিটাল কলম ব্যবহার করে একটি টাচস্ক্রিনে আবার কেউ কিবোর্ডে টাইপ করে লিখেছে। গবেষকরা একটি উচ্চ-ঘনত্বের ইলেক্ট্রোএনসেফালোগ্রাম (EEG) ব্যবহার করে মস্তিষ্কে বৈদ্যুতিক কার্যকলাপ পরিমাপ করে, ফলাফল নির্ধারণ করেন। গবেষকরা দেখেন, লেখার সময় মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলের সংযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। গবেষকদের মতে তাই ইন্দ্রিয় ব্যবহার করে সচেতন হয়ে হাতে অক্ষর গঠনের প্রক্রিয়ার ফলে মস্তিষ্কের সংযোগ বৃদ্ধি পায় এবং শিখনের উন্নতি ঘটে। তারা আরও বলেন যে যেসব বাচ্চারা ট্যাবলেটে লিখতে এবং পড়তে শিখেছে, তাদের ক্ষেত্রে মিরর ইমেজ যেমন ‘b’ এবং ‘d’ অক্ষরগুলোর মধ্যে পার্থক্য করতে অসুবিধা হতে পারে কারণ আক্ষরিক অর্থে তারা অনুভব করে না এই অক্ষরগুলো লিখতে কেমন লাগে। ‘লেখার নিয়ম’ বা ‘রুল অফ রাইটিং’ বলে যে নিজের চিন্তাভাবনায় স্পষ্টতা আনতে, গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে রাখতে বা স্পষ্টভাবে কিছু বলতে চাইলে আমাদের নিজেদের তা কাগজে কলমে লিখে রাখতে হবে। এই প্রক্রিয়ার ফলে আমাদের চিন্তন শক্তি উন্নত হয়, লেখার বিষয়বস্তু আত্মস্থ করতে সুবিধা হয়। তাছাড়াও, এমনভাবে লিখতে হবে যাতে মনে হয় আমরা কারোর কাছে তা পাঠ করবো। ফলে আমরা যা লিখছি তা পড়ার সাথে সাথে অনুমান করতে হবে শ্রোতার সে বিষয়ে কী কী প্রশ্ন থাকতে পারে। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের চিন্তনশক্তি বৃদ্ধি পাবে, চিন্তায় স্বচ্ছতা আসবে, বোধগম্যতার উন্নতি ঘটবে।
সুতরাং, মনে রাখতে হবে, শিখতে বা বুঝতে চাইলে তা লিখতে হবে, টাইপ করলে হবে না। লিখুন।