পরিবেশের স্বাস্থ্য রক্ষার্থে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় পরিযায়ী পাখিরা। গোটা বিশ্বেই। পশ্চিমবঙ্গও তার ব্যতিক্রম নয়। পশ্চিমবঙ্গ বায়োডাইভার্সিটি বোর্ডের অধীনে চার বছর আগে তৈরি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ মাইগ্রেটরি বার্ড অবজারভেশন কমিটি। ২০১৯ থেকে ২০২১- এই তিন বছর ধরে সেই কমিটি পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত জেলায় পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনা পর্যবেক্ষণ করছে। পর্যটকদের কাছে হাওড়ার সাঁতরাগাছির ঝিল পরিযায়ী পাখিদের জন্য জনপ্রিয় হয়েছে। কিন্তু শুধু সাঁতরাগাছি নয়, অবজারভেশন কমিটির একটি রিপোর্ট জানাচ্ছে মেদিনীপুরও পরিযায়ী পাখিদের এক বড় সম্পদ! তিন বছরে তাদের পর্যবেক্ষণ, পশ্চিবঙ্গের এই জেলায় ১২ রকমের প্রজাতির পরিযায়ী পাখির আনাগোনা রয়েছে! কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী গোটা বিশ্বে পরিযায়ী পাখির প্রজাতির সংখ্যা ৬০০-র ও বেশি। তার মধ্যে শুধু ভারতে এখনও পর্যন্ত পরিযায়ী পাখির প্রজাতির সংখ্যা ১০৬।
মেদিনীপুরে যে ১২ রকমের প্রজাতির পরিযায়ী পাখি দেখেছে অবজারভেশন কমিটির প্রতিনিধিরা তারা হল, ব্ল্যাক ঈগল (এদের দেখা গিয়েছে ২০২০-র ডিসেম্বরে), ইন্ডিয়ান স্পটেড ঈগল (এদেরও দেখা গিয়েছে ২০২০-র ডিসেম্বরে), হিমালয়ান বাজার্ড (এদের দেখা গিয়েছে ২০২০-র অক্টোবরে), বুটেড ঈগল (এদের দেখা গিয়েছে ২০২০-র ডিসেম্বর ও ২০২১-এর অক্টোবরে), আমুর ফ্যালকন (এদের দেখা গিয়েছে ২০২১-এর অক্টোবরে), অসপ্রে (এদের দেখা গিয়েছে ২০২০-র ডিসেম্বরে), পাইড হ্যারিয়ার (এদের দেখা গিয়েছে ২০২০-র অক্টোবর এবং ডিসেম্বরে) ওয়েস্টার্ন মার্শ হ্যারিয়ার (এদের দেখা গিয়েছে ২০২০-র অক্টোবরে) মন্টাগু হ্যারিয়ার (এরা এসেছিল ২০১৯-এর ডিসেম্বরে), ব্ল্যাক ইয়ার্ড কাইট (এদের দেখা গিয়েছিল ২০২০-র নভেম্বরে), পেরেগ্রিন ফ্যালকন (২০২০-র অক্টোবরে এদের দেখা গিয়েছিল) আর শর্ট-টোড স্নেক-ঈগল (২০২১-এর নভেম্বরে এদের দেখা গিয়েছিল)।
এদের মধ্যে ব্ল্যাক ঈগল সাধারণত দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, চিনের দক্ষিণ-পূর্বে জঙ্গলগুলোতে দেখা যায়। এদের উড়ান দর্শনীয়। ওড়ার সময় ডানা দু’টো একদম বিমানের মত সমান্তরাল হয়ে যায়। রাজকীয় ভঙ্গিমায়, একটু ‘ভি’-এর আকারে ওড়া এই পরিযায়ী পাখিদের খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল মেদিনীপুরের শালবনির জঙ্গলে।
১২ রকমের প্রজাতির পরিযায়ী পাখি মধ্যে অস্প্রেকে শীতকালে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জলাধারে দেখা যায়। বাংলায় এই প্রজাতির পাখির জনপ্রিয়তা মাছমুরাল বা মাছরাঙ্গা নামে। আর পেরিগ্রিন ফ্যালকন (বাজপাখি)। আয়তনে বড়, দীর্ঘকায় লেজ, ছুঁচোলো ও লম্বা ডানায় অনেকটা জায়গা নিয়ে ওড়া এই প্রজাতির পাখিদের গোটা ভারত জুড়েই দেলখা যায়। এরা শহরাঞ্চলেও ঢুকে পড়ে। অবজারভেশন কমিটি সেভাবেই এই প্রজাতির পাখিদের পশ্চিম মেদিনীপুরের শহরাঞ্চলেই দেখেছিল ২০২০-র অক্টোবরে। এই দুই প্রজাতির পাখির বাইরে আরও এক প্রজাতির পাখি, ইন্ডিয়ান স্পটেড ঈগলকেও ভারতের বিভিন্ন শহরে দেখা যায়। ঈগল হলেও এই পাখি কিন্তু আকারে ছোট। একটি ঘুড়ির চেয়ে সামান্য বড় এই পাখি। এর আবার ৬টি আঙুল। কিন্তু ঈগলের মতই একে দেখতে। তাই এর নাম ইন্ডিয়ান স্পটেড ঈগল।
এছাড়া আর বাকি ৯টি প্রজাতির পরিযায়ী পাখিই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে যাতায়াত করে। যেমন মন্টাগু হ্যারিয়ার বা পাইড হ্যারিয়ার প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। মূলত মধ্য ইউরোপ এবং রাশিয়া থেকে এই প্রজাতির পাখি ভারতে আসে শীতকালে। এদের সঙ্গে ওয়েস্টার্ন মার্শ হ্যারিয়ার প্রজাতির পাখিকেও মেদিনীপুরে দেখা গিয়েছিল।
তবে অবজারভেশন কমিটির পর্যবেক্ষকদের মনে হয়েছে এদের মধ্যে সবচেয়ে বিরল পরিযায়ী প্রজাতির পাখি হল আমুর ফ্যালকন। পর্যবেক্ষকরা রিপোর্টে জানিয়েছেন, আমুর ফ্যালকনের দিকে একবার তাকালে আর চোখ ফেরানো যায় না। বাজপাখির গোত্রে পড়লেও আকারে ও আয়তনে এই পাখি কিন্তু তুলনামূলকভাবে অনেক ছোট। রাশিয়া আর চিন এদের প্রজনন ক্ষেত্র। প্রত্যেক শীতে এরা রাশিয়া আর চিন থেকে বেরিয়ে চলে যায় আফ্রিকার দক্ষিণে। যাওয়ার পথে কিছু দিন কাটিয়ে যায় ভারতে। ২০২১-এর অক্টোবরে এই প্রজাতির পাখিদের দেখেছিলেন পর্যবেক্ষণ কমিটির আধিকারিকরা।
১২ রকমের প্রজাতির পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনা ও মেদিনীপুরে কিছু মাস করে থাকা জেলার বায়ো-ডাইভার্সিটির ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে চলেছে। কিন্তু এরই মধ্যে কমিটি জানিয়েছে ইন্ডিয়ান স্পটেড প্রজাতির পাখি ইতিমধ্যে বিপন্ন হয়ে পড়ছে।