পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। যিনি তার সময়ে বিখ্যাত ছিলেন পি.সি. মুখার্জি নামে। তার খ্যাতি প্রত্নতাত্বিক হিসেবে। ভারতে বড় প্রত্নতাত্বিক আবিষ্কারগুলোর মধ্যে পি সি মুখার্জি-র কাজ অন্যতম। আজ তিনি বিস্মৃতিতে চলে গেলেও তার কাজ ফেলে দেওয়া যাবে না। গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান কপিলাবস্তু-র আবিষ্কারকের নাম পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। কপিলাবস্তু আবিষ্কার করতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছিলেন ব্রিটিশ প্রত্নতাত্বিকরা। একের পর এক ভুল আবিষ্কার হছিল। ১৮৯০-এর দশকে কপিলাবস্তুর অবস্থান খুঁজতে এগিয়ে আসেন অস্টিন ওয়াডেল নামে এক প্রত্নতাত্ত্বিক। ১৮৯৩ সালে রাপ্তি নদীর মোহনায় একটি নগরের ধ্বংসাবশেষকে কপিলাবস্তু বলে উল্লেখ করেন ওয়াডেল। কিন্তু তাঁর মত মানেন না কেউই। এর মধ্যে আসল লুম্বিনী খুঁজে পেলেন ফ্যুরার। আবার শুরু হল শুরু হল অনুসন্ধান। খুঁজে দেখতে হবে নেপালের তরাই অঞ্চলে। কিন্তু এর মধ্যেই ফ্যুরার অবসর নিলেন। অতএব কাজের দায়িত্ব নেওয়ার কথা ওয়াডেলের। কিন্তু ফ্যুরার এই কাজের দায়িত্ব দিয়েছিলেন পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে।
কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি পূর্ণচন্দ্রের ছিল না। প্রবল অর্থকষ্টের মধ্যে পড়াশুনোও চালাতে পারেননি। লিখেছিলেন লখনউ শহরের ইতিহাস লেখার কাজ। সেই বই লেখার জন্য ছবি আঁকাও শিখেছিলেন। তারপর ১৮৮৩-তে সরকারি প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগে যোগ দেওয়ার পরেও সম্মুখীন হতে হয়েছিল প্রবল বাধার। যার ফলে পদত্যাগ করে পিডব্লিউডির কাজে যোগ দেন। কিন্তু পুরাতত্ত্বের প্রতি ভালবাসাকে মুছে ফেলতে পারেননি। বিহারের ললিতপুর ও আশেপাশের নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন খুঁজতে থাকেন তিনি। আর এএসআই থেকে আবার তার ডাক আসে ১৮৯৭-য়ে। পাটুলিপূত্র নগরের সন্ধানে তখন খননকার্য চলছে। সেই কাজের তদারকির ভার দেওয়া হয় পূর্ণচন্দ্রকে। কাজ শুরু হল ১৮৯৯-এর জানুয়ারিতে। তাতেও আবিরাম বাধার সামনে পড়তে হয়েছিল পূর্ণচন্দ্রকে। প্রধান বাধাদানকারীদের মধ্যে ছিলেন সেই ওয়াডেল। পূর্ণচন্দ্রের নামে সরকারের কাছে নালিশও করেন। সরকার অবশ্য পূর্ণচন্দ্রকে তার কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে বলেন। ওয়াডেলের বাধায় বিরক্ত হয়েও পূর্ণচন্দ্র হাল ছাড়েননি। এর আগে পাটুলিপূত্র নগরের সন্ধানে খননকার্য করেছেন তিনি। সেখান থেকেই ওয়াডেলের সঙ্গে তাঁর শত্রুতা। সেবারেও ওয়াডেলের বদলে পূর্ণচন্দ্রকেই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। অতএব এমন ঝামেলা সামলানোর অভিজ্ঞতা তাঁর আছে। খননের কাজ করতে করতে পূর্ণচন্দ্রের মনে হয়েছিল তিলৌরাকোট অঞ্চলের কথা। যে অঞ্চলটি বারবার উপেক্ষা করে গিয়েছেন ইংরেজ প্রত্নতাত্বিকরা। তিলৌরাকোটে খননকার্য শুরু করলেন পূর্ণচন্দ্র। কিন্তু সেই কাজেও বাধা! শ্রমিক নেই! অধিকাংশ শ্রমিককে নিয়ে ওয়াডেল চলে গিয়েছেন গোতিহাওয়া। পূর্ণচন্দ্র থামেননি। গুটিকয়েক শ্রমিককে নিয়ে তার খননের কাজ চলতে থাকল। ওয়াডেল যখন ফিরলেন তখন তাঁর সামনে কপিলাবস্তুর ধ্বংসস্তূপ!
পূর্ণচন্দ্রের অনুসন্ধান যে নির্ভুল, সে-বিষয়ে সকলেই একমত হয়েছেন। এমনকি ওয়াডেল নিজেও সম্মতি জানিয়েছেন। হারিয়ে যাওয়া গৌতম বুদ্ধের রাজধানী খুঁজে বের করে পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ভারতের ইতিহাসে ঢুকে পড়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, ভারতের ইতিহাসে স্মরণীয় বাঙালিদের উল্লেখে পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নাম আজ বিস্তৃতিতে। কিন্তু তাঁকে ছাড়া ভারতের নৃতত্ত্ব গবেষণা সংস্থার অন্যতম এই কৃতিত্ব অধরাই থেকে যেত।