ঘটনাটা ২০০৮-এর। উত্তর গোয়ার সিওলিমের এক রাস্তায় তিন পা-ওলা একটি গরু আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে রাস্তা পেরনোর! কিছুতেই সে পারছে না। গরুটিকে ধাক্কা মেরে পথচারীদের রাস্তা পার হওয়ার দৃশ্য দেখছিলেন এক ভদ্রলোক। তিনি গরুটিকে ধরে রাস্তা পার করে দেওয়ার চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু ট্র্যাফিক পুলিশের তাতেও আপত্তি! গরুর মালকিনের সম্মতি নিতে হবে। তাও কোর্ট পেপারে! ভদ্রলোক সেই মালকিনকে খুঁজে বার করলেন। তার মৌখিক সম্মতি নিলেন। গরুটিকে আর লালন পালন করার ক্ষমতা ছিল না দরিদ্র ওই মালকিনের। নিঃশর্তে ওই তিন পায়ের গরু চলে গেল ভদ্রলোকেরু হেফাজতে। সে বাঁচল আসলে।
ভদ্রলোকের নাম? অতুল সারিন। বয়স ৫৮। গত ১৬ বছর ধরে সিওলিম শহরতলীর বাসিন্দা তিনি ও তার পরিবার। যদিও শৈশব কেটেছে কেনিয়ায়। যৌবন কেটেছে লন্ডনে। কিন্তু তাকে ঘিরে গোয়া এবং ভারতের অসংখ্য মানুষের আজ যে আকর্ষণ তার মূল কারণ, গুরুতরভাবে আহত, পঙ্গু, চোটগ্রস্ত পশুপ্রাণীদের ইশ্বর হয়ে উঠেছেন অতুল সারিন। গত ১৬ বছরে গোয়ায় অন্তত ১৫ হাজার চোটগ্রস্ত, গুরুতরভাবে আহত হওয়া, পঙ্গু পশুপ্রাণীদের তিনি বাঁচিয়েছেন, নিজের কাছে এনে তিনি ও তার পরিবার সেই প্রাণীদের ফিরিয়ে দিয়েছেন সুস্থ জীবন। তার আখড়ায় থাকা পশুদের মধ্যে মূলত রয়েছে গরু, কুকুর, বেড়াল ও ছাগল। অতুল সারিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ান গোয়ায়। পরিত্যক্ত, পঙ্গু, চোট পাওয়া পশুপ্রাণী দেখলেই তাকে নিয়ে আসেন নিজের ঘরে। নিঃশব্দে তার এই কাজ চলছে ২০০৮ থেকে। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় অতুলের মুখে চলে আসে ২০০৮-এর ওই তিন পা-ওলা গরুকে বাঁচানোর ঘটনা। তারপরই শুরু সারিনের উদ্ধারকাজ। সেই তিন পায়ের গরুটি ছিল সারিনের প্রথম উদ্ধার। তার নাম সারিন দিয়েছেন তারা।
কেনিয়ার মোম্বাসায় শৈশব কেটেছে সারিনের। বাবার সঙ্গে প্রায়ই যাতায়াত ছিল মোম্বাসার বন্যপ্রাণী সংরক্ষিত পার্কগুলোয়। মূলত আর্থিক দৈন্যতা কাটাতেই সারিনের বাবা-মা ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ইংল্যান্ডে গিয়ে থাকতে শুরু করেন। তখন সারিনের বয়স ১৩। আইন নিয়ে স্নাতক হওয়ার পর সারিন বাবার গার্ডেনিং আর হার্ডওয়্যার স্টোরে কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু বেশিদিন ভাল লাগেনি। থাকেনওনি ইংল্যান্ডে বেশিদিন। ২০০৫-এ ওখান থেকে চলে আসেন ভারতে। গোয়ার উত্তরে সিওলিমে বাসা বাঁধেন। একটা বাড়ি কিনে চারপাশটা বাগানে ভরে দিয়েছিলেন। অক্টোবর থেকে মার্চ গোয়ায় পর্যটকদের প্রবল ভিড় থাকে। সারিনের ঘরে তখন পর্যটকরা ভাড়ায় থাকতেন। সেই সময়টাই অতুল সারিনের কর্মজীবনের টার্নিং পয়েন্ট।
তার বাড়ির সামনেই দু’দুটো সি-বিচ। প্রত্যেকদিন সি-বিচে গিয়ে সারিনের চোখে পড়ত রাস্তার কুকুরদের। প্রচুর কুকুর দেখেছিলেন যারা খেতে না পেয়ে মারা যাচ্ছে। তাদের জন্য প্রত্যকদিন খাবার আন্তেন সারিন। তখন থেকে সারিনের মনে হওয়ার শুরু ওদের বাঁচানোর কথা, ওদের লালন পালন করে সংরক্ষণ করার১০ কথা। তারপর তৈরি করলেন এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ওয়েলফেয়ার ফর অ্যানিম্যালস ইন গোয়া।
আজ অতুল সারিনের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা শুধু গোয়ায় নয়, গোটা ভারতেই অন্যতম আলোচিত নাম। ২০১২-তে গোয়ার সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে সারিনের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে। ৫ হাজার গরু সেখানে রয়েছে। তার সঙ্গে কুকুর, বেড়াল, ছাগল, বাঁদর, হনুমান, শুয়োর এবং অনেক প্রজাতির পাখিও সারিনের চিড়িয়াখানায়। প্রত্যেক প্রাণীর মধ্যে একটাই মিল যে, ওদের যখন সারিন খুঁজে খুঁজে রাস্তা থেকে এনেছিলেন, প্রত্যেকেই নানারকমের অসুস্থতায় মারা যাওয়ার মত অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল! সারিন শুধু ওদের খাওয়া, থাকার ব্যবস্থাই করেননি, ওদের জন্য তৈরি করেছেন এক মিনি-হাসপাতালও!