দক্ষিণ কোরিয়ার একদল পদার্থবিদ দাবি করেছেন, তারা এমন এক উপাদান তৈরি করেছেন, যা ঘরের তাপমাত্রাতে সুপারকন্ডাক্টর হিসেবে কাজ করেছে। এই দাবি সত্যি হলে শক্তি উৎপাদন এবং তার পরিবহনে, যাতায়াতের মাধ্যমে, কম্পিউটিং এবং প্রযুক্তির অন্যান্য ক্ষেত্রে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। গবেষকদের তৈরি করা উপাদান হল LK-99, যা একটি সীসা-ভিত্তিক যৌগ, এবং ঘরের তাপমাত্রায়, পারিপার্শ্বিক বায়ুচাপে এটা সুপারকন্ডাক্টর হিসেবে কাজ করছে বলে তার দাবি করেন।
সুপারকন্ডাক্টর কী? সুপার কন্ডাক্টার বলতে এমন পরিবাহী বোঝায়, যা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই বিদ্যুৎ পরিবহন করে। যখন একটা সাধারণ পরিবাহী তার যেমন তামার মধ্যে দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ হয়, তখন পরমাণুর ইলেকট্রনগুলো একে অন্যের সাথে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে যায়। ফলস্বরূপ, ইলেকট্রনগুলো কিছু শক্তি হারায় এবং তারটা উত্তপ্ত হয়ে যায়। একটি সুপারকন্ডাক্টরে, ইলেকট্রন কোন প্রতিরোধ ছাড়াই চলাচল করে। সুপারকন্ডাক্টিং তারগুলিতে শক্তি না হারিয়ে ইলেকট্রন খুব সহজে চলাচল করতে পারে ফলে প্রতিরোধ ছাড়াই বিদ্যুৎ পরিবহন হয়। সুপারকন্ডাক্টিং চুম্বক এত শক্তিশালী হয় যে তা ট্রেনকে উত্তোলন করতে পারে। যখন কোনো গ্যাস অত্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে যায়, যে তার পরমাণু থেকে ইলেকট্রন বেরিয়ে আসে, তখন সেখান পদার্থের আর একটি দশা দেখা যায়, প্লাসমা দশা, যেখান পরমাণু, ইলেকট্রন, আয়োনাইজড গ্যাস সবই বর্তমান থাকে, এই প্লাসমা দশায় তাপমাত্রা সূর্যের কেন্দ্রের থেকেও বেশি। সুপারকন্ডাক্টরে এই প্লাসমা দশা বিদ্যমান।
দক্ষিণ কোরিয়ার এই গবেষণা বৈজ্ঞানিক মহলে যথেষ্ট আলোড়ন ফেলে দিয়েছে। অনেকে তাদের গবেষণার বাস্তবতার ওপর আঙুল তুলেছেন। কারণ সমস্ত পরিচিত সুপারকন্ডাক্টর কার্যকরী হওয়ার জন্য খুব কম তাপমাত্রা , সাধারণত – ১০০℃ -এর কম তাপমাত্রা বা অত্যন্ত উচ্চ চাপ, সাধারণ বায়ুমণ্ডলীয় চাপের ১০০০০০ গুণ বেশি চাপ প্রয়োজন হয়। এই প্রতিবন্ধকতা সুপারকন্ডাক্টরের প্রয়োগ যেমন ব্যয়বহুল করে তোলে তেমন এর ব্যবহারিক প্রয়োগ বিশেষ সম্ভব হয় না।
দক্ষিণ কোরিয়ার গবেষকরা বলছেন LK-99 একটি বেকিং প্রক্রিয়ায় খনিজ ল্যানারকাইট (Pb₂SO₅) এবং কপার ফসফাইড (Cu₃P) একত্রিত করে তৈরি করা যেতে পারে। তাদের দাবি এই উপাদানটি স্বাভাবিক বায়ুর চাপে এবং ১২৭℃ পর্যন্ত তাপমাত্রায় সুপারকন্ডাক্টিভিটির দুটি মূল লক্ষণ দেখিয়েছে, ১। শূন্য প্রতিরোধ এবং ২। চৌম্বকীয় লেভিটেশন।
LK-99 ঘরের তাপমাত্রায় কিভাবে সুপারকন্ডাক্টিভিটি প্রদর্শন করতে পারে তার একটি যুক্তিসঙ্গত তত্ত্ব তারা প্রস্তাব করেছেন , কিন্তু এটার নির্দিষ্ট পরীক্ষামূলক প্রমাণ এখনও দিতে পারেননি। সুপারকন্ডাক্টরের চিহ্নের মধ্যে একটি হল মেইসনার প্রভাব, যেখানে চুম্বকের উপরে স্থাপন করলে এটি নিজেকে উত্তোলন করে। একটি ভিডিও প্রদর্শনীতে, গবেষকরা একটি চুম্বকের উপরে LK-99 এর একটি অংশ স্থাপন করেন। সেখানে LK-99 এর ফ্ল্যাট ডিস্কের একটি প্রান্ত উপরে উঠে যায়, কিন্তু অন্য প্রান্তটির চুম্বকের সাথে স্পর্শ করে আছে বলে মনে হয়।
অতীতে গবেষকদের বেশ কয়েকটি দল ঘরের তাপমাত্রায় বিভিন্ন পদার্থের সুপারকন্ডাক্টিভিটি সনাক্ত করা গেছে, তা দাবি করেছেন, তবে সেই দাবিগুলির একটিও গ্রাহ্য করা হয়নি। কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজির ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্স, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, মাহবুবেহ শাহবাজী জানিয়েছেন, এই গবেষণার কাগজপত্র পর্যালোচনা করে বর্ণিত পরীক্ষাগুলো অন্যান্য গবেষণাগারে করে দেখা হবে যে ঘরের তাপমাত্রায় এটা সুপারকন্ডাক্টর কিনা। এই দাবি বৈধ এবং নিশ্চিত হলে, এটা পদার্থবিদ্যা এবং উপকরণ প্রকৌশলের সবচেয়ে যুগান্তকারী অগ্রগতিগুলির একটি হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।