বছরখানেক আগে পুজোর ছুটিতে ডুয়ার্স গেছিলাম, চিলাপাতা-মেন্দাবাড়ি ফরেস্ট। এই নিয়ে সাত-আটবার ডুয়ার্স যাওয়া হয়ে গেল, গোরুমারা, বক্সা, জলদাপাড়া মিলিয়ে। প্রতিবারই রোমাঞ্চ আর ভালোলাগায় মনটা ভরে ওঠে ডুয়ার্সের নামটা শুনলেই। ওখানকার বন্যপ্রাণ, প্রকৃতি, জঙ্গল, মানুষের জঙ্গলভিত্তিক জীবনপ্রবাহ, অর্থনীতি সবটাই আমাকে খুব টানে।
তবে আজ লিখতে বসেছি এমন একটা বিষয়ে যেটা নিয়ে চর্চা বহু পুরনো এবং ভীষণই প্রাসঙ্গিক, Human Animal Conflict (HAC).
জঙ্গল নির্ভর অনেকের সঙ্গে আলাপচারিতা ও বিভিন্ন সরকারি বেসরকারী তথ্যসূত্রের সাহায্যে, জঙ্গল এবং বন্যপ্রাণকে ভালোলাগার মন নিয়ে, নিজের উপলব্ধির কথা এখানে জানাব।
ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক ভাবেই নর্থবেঙ্গল ছিল জঙ্গল নিবিড় এলাকা। পরিবেশগত সুবিধায় চা চাষের একমাত্র উপস্থিতি এখানে। ব্রিটিশরা চা বাগানের মজদুর হিসাবে সুদূর ওড়িশা, ছোটনাগপুর, বিহার থেকে নিয়ে আসেন শ্রমিকদের যারা এখানে পরবর্তীকালে বসতি স্থাপন করেন। দেশভাগ এবং চীন যুদ্ধের পর, মিলিটারী স্ট্রাটেজিক এরিয়া হওয়ায়, মিলিটারি এস্টাবলিশমেন্টগুলো একে একে স্থাপন হতে থাকে। ক্রমে ব্যবসাবানিজ্যে সমৃদ্ধি ও নগরায়ন হয়। এইসবগুলোই হিমালয়ের পাদদেশ জুড়ে উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ জঙ্গলকে fragmented করে দেয়, অর্থাৎ জঙ্গলের অবস্থানগত যে contiguous nature সেটা নষ্ট হয়ে গেল। তাছাড়া প্রচুর নদনদী আগে থেকেই বিস্তীর্ণ জঙ্গলকে কিছুটা বিভাজিত করে রেখেছিল। নগরায়নের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রেলপথ, সড়কপথ ইত্যাদি গড়ে উঠল।
এর ফল হল মারাত্মক। বন্যপ্রান কোনো দেশ, সীমান্ত বোঝে না। Migration তাদের মজ্জাগত। বছরের বিভিন্ন সময়ে বিশেষত খাবারের খোঁজে, জলের খোঁজে, আরও নানা কারনে তারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায়। হাতীর মত প্রাণীদের এই যাতায়াত বছরের পর বছর এক একটা নির্দিষ্ট পথভিত্তিক। এটাই Elephant Corridor.
কয়েকবছর আগের হিসাবে উত্তরবঙ্গে দুশোর বেশি চিহ্নিত Elephant Corridor আছে, সাতশোর বেশি হাতির জন্য। এখন জনবসতির চাপে একেই জঙ্গল fragmented, তার ওপর চা-বাগান, চা-বাগানের শ্রমিক লাইন, বনবস্তি, রাস্তা, রেলপথ সবই সেই corridor এর ওপর।
আগেই বলেছি, বন্যপ্রাণ দেশ মানে না, সীমান্ত মানে না, নির্দিষ্ট corridor তাদের অধিকার। সেই অধিকার বজায় রাখতে গিয়েই যত সমস্যা। মানুষের সঙ্গে, তাদের রেললাইন,চাবাগান, শ্রমিকবস্তি, বনবস্তির সঙ্গে তখন বন্যপ্রাণের সংঘাত-Human Animal Conflict.
তবে যে শুধু যাতায়াতে বাধাপ্রাপ্তি, এটাই একমাত্র কারন নয়। Conservation policy র সাফল্য, জাতীয় উদ্যান হিসাবে ঘোষণা, এইসবের ফলে জঙ্গলে তৃণভোজীর সংখ্যা বেড়েছে।ফলে লতা, গুল্ম, ঘাস পরিমাণে কম পড়েছে হাতির, তখনই জঙ্গলের বাইরের খাবারের দিকে বাধ্য হয়ে নজর পড়ছে (obligate raid)।
তাছাড়া আর একটা কারণ জঙ্গলের বাইরে আসার হল opportunistic raid, অর্থাৎ পছন্দের খাবারের লোভে জঙ্গলের লাগোয়া এলাকায় হানাদারী। এটা আবার HAC সমাধানের একটা পদক্ষেপের বিপরীত প্রভাব।
বিষয়টা খোলসা করা যাক। দীর্ঘদিন ধরেই জঙ্গলের ভেতরে জনবসতি ছিল-বনবস্তি। জঙ্গলই তাদের জীবিকার কেন্দ্র ছিল। HAC তখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। জাতীয় উদ্যান ঘোষণার পর স্বভাবতই সরকারি প্রকল্পে তাদের পুনর্বাসন দেওয়া হয় জঙ্গলের বাইরে লাগোয়া এলাকায়। তাদের চাষবাসের জমি দেওয়া হয় জঙ্গলের লাগোয়া এলাকায় জমি পরিস্কার করে।
ধান, ভুট্টা, সরষে তারা চাষ করে আর ভুট্টা, ধান পাকলেই opportunistic raid শুরু হয় গজরাজদের, Human Animal Conflict বেড়েই চলে। তথ্যসূত্রের পরিসংখ্যান বলছে, ধান যখন পাকে বছরের সেই সময়টাতেই casualties বেশি হয় human life এর। উঠোনের গোলার সঞ্চিত ধান, মদের ভাটিখানাও হাতির হামলার লক্ষ্যস্থল হয়ে ওঠে।
বিভিন্ন তথ্যনির্ভর আলোচনায় দেখা গেছে সন্ধ্যা ছ’টা থেকে ন’টার মধ্যে হাতীর আক্রমন সব থেকে বেশী।
কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেছে ওই সময়টাতে জঙ্গল লাগোয়া জনবসতিতে মানুষের যাতায়াত বেশি। বস্তির মোড়ের টিমটিমে আলো জ্বলা একটি মুদি দোকান, একটি চায়ের দোকানে তখন মানুষের জটলা চলছে, কেউ কাজ সেরে ওখানে যাচ্ছেন, কেউ কেউ একটু নেশা করে টালমাটাল হয়ে অন্ধকার রাস্তায় বাড়ির বা চায়ের দোকানের পথ ধরেছেন, অসাবধানতাবশত হাতীর সামনে পড়ে গেছেন একলা,Human Elephant Conflict(HEC).
চিলাপাতায় এইরকম একটি মুদিখানা কাম চায়ের দোকানে কথা বলে জানলাম, ধান পাকার সময়ে বিকেলে চারটে থেকে পাঁচটার মধ্যে সবাই দোকান বন্ধ করে বাড়ি চলে যায়, সতর্কতা বাড়ছে।
উৎসবে আনন্দে একটু বেসামাল হয়ে অনেকেই জীবন দিয়ে মূল্য চোকায়। জলদাপাড়ায় শুনেছিলাম বছর কয়েক আগে কালীপুজোতে যাত্রা দেখে সন্ধ্যা আটটা নাগাদ জঙ্গল লাগোয়া রাস্তা দিয়ে ফেরার সময় স্বামী-স্ত্রীকে পিষে দিয়েছিল একটি দাঁতাল। উৎসবের আবহে ওঁরাও দম্পতি নেশা করেছিল, সেটার গন্ধই কি যমদূত-দাঁতালকে টেনে এনেছিল?
বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞরা সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না।
তবে পুরো বিষয়টা একপাক্ষিক নয়। উচ্চগতির ট্রেন, দ্রুতগামী বাস, ট্রাক অনেকক্ষেত্রেই ঘাতক হয়ে দেখা দেয়। হাতী, ভারতীয় বাইসন, হরিণ, লেপার্ড মাঝেমধ্যেই মারা পড়ে। আগেই বলেছি, জঙ্গলে তৃণভোজীর সংখ্যা বাড়ায়, খাদ্য পিরামিডের ওপরের স্তরে লেপার্ডের সংখ্যাও বেড়েছে। HAC এ লেপার্ডও এখানে আরেকটি পক্ষ।জঙ্গলে শিকার ধরতে সক্ষমতার চুড়ান্তে পৌঁছাতে হয়। আহত বৃদ্ধ লেপার্ড তখন জঙ্গলের prey base এর ওপর ভরসা রাখতে পারে না। আবার জঙ্গল fragmented হয়ে যাচ্ছে-জঙ্গল লাগোয়া পুনর্বাসন প্রাপ্ত বনবস্তির সংখ্যা বাড়ছে-তাদের পালিত গবাদি পশুগুলো তখন easy prey হয়ে যায় লেপার্ডের কাছে-সংঘাত বাড়ছে। গোরুমারার ধূপঝোরাতে এইরকম একজন গৃহস্থের হাহাকার শুনেছিলাম,ওনার দু-দুটো গোরু লেপার্ড kill করেছিল। অর্ধভুক্ত দেহদুটিই পেয়েছিলেন। এই হাহাকারই জন্ম দেয় প্রতিহিংসার। ছড়িয়ে রাখা টোপ দেওয়া বিষে মারা পড়ে হানাদার লেপার্ড।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে লেপার্ড আক্রমণের ৭০% ই হয়েছে চা বাগানে আর বেশিরভাগ আক্রান্তরা হলেন মহিলা চা-পাতা সংগ্রাহক। আসলে চা বাগানে চা গাছের সারির মধ্যেকার জলনিকাশী নালা স্ত্রী লেপার্ডের প্রসবের preferred place. মা লেপার্ড বাচ্চাদের নিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে চায় ওখানে। পাতা সংগ্রাহক মহিলাদের সঙ্গে সংঘাতের মূল কারন এটাই।
গোরুমারার রামসাই রাইনোক্যাম্পের রাঁধুনি যুবকটি একবার চা বাগানের ভেতর দিয়ে যাবার সময় আক্রান্ত হয়েছিল, সে গল্প ওর মুখেই শোনা। তাই পরদিন সকালে হেঁটে চুকচুকি লেকে যাবার প্ল্যান স্থগিত রেখে গাড়ি নিয়ে গেছিলাম। কারন হাঁটা পথের বেশিরভাগটাই চা-বাগানের ভেতর দিয়ে।
জঙ্গল লাগোয়া বসতিতে ভারতীয় বাইসন আর গন্ডারের প্রবেশ মাঝেমাঝেই হয়। ভারতীয় বাইসন হল একমাত্র গবাদি (Bovine) পশু যারা গৃহপালিত নয়, কোনো চিড়িয়াখানায় এদের দেখা মেলেনা। কারনটা জানলাম, অতবড় চেহারা হলেও ওদের হার্ট খুবই দূর্বল,লোকালয়ে তাড়া খেয়ে, ভীষণ ছোটাছুটির পর বেচারারা হার্টফেল করেই মারা যায়।
এখন প্রশ্ন HAC কি অনিবার্য? বন আধিকারিকরা, বন্যপ্রান বিশেষজ্ঞরা নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন নতুন নতুন উপায় বার করতে। বিজ্ঞানভিত্তিক প্রযুক্তিগত দিকগুলো (solar high voltage electric fencing around forest, underpass/over bridge on railway track, boundary wall, খাল খনন ইত্যাদি) র পাশাপাশি স্থানীয় বনবস্তির মানুষ, বন্যপ্রান বিভাগের আধিকারিক, কর্মচারী, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নিয়ে যৌথমঞ্চ গঠন করে মানুষকে সচেতনতার সঙ্গে সংঘাত এড়ানোর পথও বাতলে দেবার কাজ চলছে। ধান পাকলে যৌথবাহিনীর পাহারা চলে, উচ্চশক্তির টর্চ, পটকা, শব্দ করার টিন নিয়ে জমির ধারে গাছের ওপর টোঙ বানিয়ে রাত পাহারার ব্যবস্থা থাকে। দূরে হাতির দল দেখলেই কাজ শুরু হয়ে যায়। খেতের fencing এ গোলমরিচ আর শুকনো লঙ্কা গুঁড়োর পুটলি ঝুলিয়ে রাখার নিদানও দেওয়া হচ্ছে, যাতে ঝাঁঝালো গন্ধে হাতীরা পিছু হটে।
এ তো গেল যদি আসে তবে তাড়ানোর উপায়। পাশাপাশি জঙ্গলেই হাতীদের খাবারের প্রয়োজন মেটানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।ধূপঝোরায় পড়ন্ত বিকেলে দলে দলে জঙ্গল থেকে সাইকেল আরোহীর বেরিয়ে আসা দেখে, প্রশ্ন করে জানা গেল, ওরা জঙ্গলে পুরুন্ডি, ঢাড্ডা ঘাস ও কলাগাছ plantation এর কাজ করছে।
হাতী, গন্ডার,ভারতীয় বাইসনের প্রিয় ঢাড্ডা ও পুরুন্ডির পুরুষ্ট ডাঁটা। জঙ্গলে ঠিকমত খাবার পেলে কে আর দ্বিপদ বিপদের কাছে আসতে চায়!
এই প্রসঙ্গে বলি, মেদলা ওয়াচ টাওয়ারের ফরেস্ট অফিসের কর্মীদের রাতের খাবারের মেনুতে পুরুন্ডির চচ্চড়ি দেখে চমৎকৃত হয়েছিলাম!
হাতি তাড়ানোর অন্যতম উপায় high voltage solar electric fencing এর চালাকি কিন্তু বুদ্ধিমান হাতিরা ধরে ফেলেছে। ওই তারের ওপর গাছ ফেলে হাতিরা fence গুলো ground level এ নিয়ে আসে আর সহজেই টপকে যায়,” Necessity is the mother of all inventions”.
শেষে বলি, সভ্যতার অগ্রগতি চলবে আর চলবে জঙ্গল, বন্যপ্রান সংরক্ষণের সর্বতো আন্তরিক প্রচেষ্টা। কেউ যেন কারো পথে অন্তরায় না হয়। সভ্যতার অগ্রগতি, প্রযুক্তির অগ্রগতি, মানুষের শুভবোধের কাছে এটাই কামনা।