“স্নিগ্ধ তুমি, হিংস্র তুমি, পুরাতনী তুমি নিত্যনবীনা,
অনাদিসৃষ্টির ‘যজ্ঞহুতাগ্নি থেকে বেরিয়ে এসেছিলে সংখ্যাগণনার অতীত প্রত্যুষে”
রবিঠাকুরের পৃথিবী আবাহণী অবশ্যই শোনেননি সার্ন-এর লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের হাজারো বিজ্ঞানী। যাঁরা যজ্ঞপুরিতে খোদাইকারের মতো প্রতিমুহূর্তে সত্য সন্ধান করছেন, অসংখ্য ‘না’ এর মাঝখানে ‘হ্যাঁ’ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। বিশ্ব ভাবনা আর প্রকৃতির উন্মেষের যোগসাধনের এইরকম মহাদানবীয় কাণ্ডকারখানা প্রতিদিন জ্ঞানসাগরে তুলে আনছে ঢেউ। বিশাল এই পৃথিবীর সব থেকে ছোট কণা নির্মাণের মধ্য দিয়ে রূপসাগরের অতল থেকে তুলে আনছেন এক একটা অণু, পরমাণু। যা আবার আরও প্রশ্নের সামনে ফেলে দিচ্ছে বিজ্ঞানীদের। কেন? কারণ এটাই বিজ্ঞানের ‘অসুখ’। প্রতিনিয়ত গভীর জিজ্ঞাসা, ছটফটানি, জ্ঞানের সীমান্ত ছাড়িয়ে পথ হাঁটতে না পারলে বিজ্ঞানীর সুখ হয় না। সুইজারল্যান্ডের সার্ন-এর মাটির নীচে ২৭ কিলোমিটার এক দানবীয় বিদ্যুত-চুম্বক শক্তির আখড়ায় অনেকগুলো প্রকোষ্ঠে ভাগ ভাগ করে নিবিষ্ট মনে বিজ্ঞানীরা জপতপ করছেন- নতুনের মন্ত্র। ২০০৮ সালে শুরু বস্তুবিজ্ঞানের সেই সুরের বাসরে উঠে এসেছে অনেক নতুন মাধুরী। ২০১২ সালে হিগস্-বোসোন কণা আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে তার গর্বিত পথ চলা শুরু। এরপরে একে একে এই গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরা খুঁজে বের করেছে এখনও পর্যন্ত অন্ততঃ ৬২টি কণা, যা এতদিন অজানা ছিল। বস্তুর গঠনগত বৈচিত্র্যের ভাঁজে ভাঁজে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির রূপকথা লুকিয়ে থাকে। বিজ্ঞানীদের লক্ষ্যই থাকে সেগুলো বার করা গভীরে, আরও গভীরে গিয়ে। বিশ্ব বিজ্ঞানের জয়যাত্রার ধ্বজা উড়িয়ে পারসিভিয়ারেন্স যখন মঙ্গলে মাটি খুঁড়ছে তখন সার্ন-এর বিজ্ঞানীরা হাতে হাত মিলিয়ে বস্তুর রূপসাগরে অরূপরতন খুঁজছেন। মিলছেও মনি-মানিক্য। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল হ্যাড্রন কণার আবিষ্কার। বস্তুর সব থেকে যে ছোট রূপ– মৌলিক রূপ যা মুলত কোয়ার্ক নামে পরিচিত তারা দুটি বা তিনটিতে হাতে হাত মিলিয়ে একটি হ্যাড্রন গঠন করে, যার উদাহরণ নিউট্রন বা প্রোটন। সার্ন-এর জন্মলগ্ন থেকেই অনেকগুলি হ্যাড্রন কণার আবিষ্কার আজ অব্দি হয়েছে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে, ২৯শে জুলাই সাইরাকিউজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুপদার্থবিজ্ঞানী ইভান পলিইয়াকভ বর্ণনা করেছেন একটি নতুন হ্যাড্রনের- যা গঠিত চারটি কোয়ার্কের সম্মিলনে! বিস্ময়ের বই কি! তত্ত্বগতভাবে চারপেয়ে হ্যাড্রনের কথা আগেও আন্দাজ করা গিয়েছিল কিন্তু তার অস্তিত্বের জোরদার প্রমাণ এই প্রথম পাওয়া গেল। অনেকটা হিমালয়ের মাথায় ইয়েতির পায়ের ছাপ দেখতে পাওয়ার মতো।
কয়েকটা কোয়ার্ক মিলে তৈরি হয় হ্যাড্রন। আর এই হ্যাড্রনগুলির মধ্যে থাকে শক্তিশালী আকর্ষণ, যা একে অপরের দিকে টানে। ছোট ছোট অণু-পরমাণু নিজেদের মধ্যে কিভাবে জোট বাঁধে বা বিছিন্ন হয়– তার উপর দাঁড়িয়ে ঠিক হয় পৃথিবীতে মুহূর্তে ক্রিয়াশীল শক্তির নানান প্রকাশ। বিজ্ঞানীদের ধারণা এই ধরণের চারপেয়ে হ্যাড্রন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জন্মলগ্নেই একমাত্র বিদ্যমান ছিল। ফলত এই কণার আবিষ্কার বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি বিষয়ে নতুন আলোকপাত ঘটাবে বলেই তাঁদের আশা। নিউট্রন, প্রোটনের পরিধিকে আরও বিস্তৃত করার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলির প্রায়োগিক রূপ কী তা আরও দৃঢ়ভাবে বোঝার চেষ্টা করা।
হ্যাড্রনের অ্যালফাবেট আর রামধনু যত বিস্তৃত হবে মানুষের জ্ঞানের পরিধি তত বাড়বে। আবিষ্কৃত এই হ্যাড্রনগুলির মধ্যে কোনোটা ভীষণই ক্ষণস্থায়ী, প্রায় ধরাই পড়ে না, চোখে তো আসেই না। কেউ বা অপেক্ষাকৃত বেশী সময় স্থায়ী হয়, হয় অপেক্ষাকৃত স্তিতধী। এই সমস্ত দেখতে দেখতে বিজ্ঞানীরা আলোড়িত হচ্ছেন প্রতিটা আবিষ্কারে, আপ্লুত হচ্ছেন কিন্তু চটজলদি কোনো সিদ্ধান্তে এখনই আসছেন না। লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে কণা আবিষ্কারের এই চেষ্টা করা হয় প্রলয়ের পথ বেয়েই। সংঘর্ষ ছাড়া সৃষ্টি হয়না– এই তত্বের অনুসারী হয়ে পলিয়াকভের সহযোগী গবেষক ভানিয়া বেলায়েভ (মস্কো) বলেছেন যে ‘প্রথমে ভেবেছিলাম ভুল দেখছি! অগ্ন্যুৎপাতের পর ছড়িয়ে পড়া ছাইয়ের মধ্যে থেকে সোনা খুঁজে বার করার মতো এই কাজ অত্যন্ত জটিল’। ভুলের সম্ভাবনাও বিজ্ঞানীরা সবসময় মাথায় রাখেন। নবতম এই হ্যাড্রন তারকা আবিষ্কার অসীম বিশ্বের কত অজানাকে যেমন এগিয়ে দিয়েছে, তেমনি বিজ্ঞানীদের ভাবতে বাধ্য করছে যে ‘পার্টিকল’ কী, কোনটা, তা ঠিক করার জন্য আরও নিবিড় ভাবনা-চিন্তা করা দরকার। পলিয়াকভের গবেষণাপত্রটি পেশ করা হয়েছে ইউরোপিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটির ভার্চুয়াল মিটিং-এ’।