৭ই মে ১৮২৪ সাল- সন্ধ্যা ৭টা। পিয়ানো, ফ্লুট, ড্রামের লহরী সবে তখন শুরু হয়েছে। শিল্পীরা গা ঘামিয়ে নিচ্ছেন কনসার্টের জন্য। ভিয়েনার বিখ্যাত এম কারনার্টো থিয়েটার। কয়েক মুহুর্ত পরেই শুরু হবে ভুবনজয়ী নাইনথ সিম্ফনীর বিশ্ব প্রিমিয়ার। হঠাৎ তুমুল হর্ষধ্বনি, কেটল ড্রাম, বিউগলের আওয়াজ হল জুড়ে। মঞ্চে এসে দাঁড়িয়েছেন লুড উইগ ভন বিঠোফেন। ঝালিয়ে নিচ্ছেন মঞ্চের চারপাশটা। সাধনায় মগ্ন হবার আগের মুহুর্ত। হলের উল্লাস থামছেইনা, অথচ বিঠোফেন দর্শকদের দিকে পিছন ফিরে একমনে সহশিল্পীদের দেখে যাচ্ছেন, ইতি উতি চাইছেন। কেমন যেন অবাক করা ব্যবহার চিরবিনয়ী স্রষ্টার। একি হলো বিঠোফেনের- মঞ্চের সহশিল্পীরাও ঠাওর করতে উঠতে পারছেন না। এবার না পেরে বিঠোফেনের হাত ধরে টানলেন এক সহশিল্পী। ধাক্কা দিয়ে সামনের দিকে মুখ ফেরাতে ইঙ্গিত করলেন। স্মিত হাসি সুরের জাদুকরের। নতমস্তকে দর্শকের অভিবাদন নিলেন। এরপরেই শুরু হলো সুরের ঝর্নাতলায় নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ।
নাইনথ সিম্ফনী কালের ইতিহাসে ঢুকে গেছিল এরপর। কিন্তু যে প্রশ্নের উত্তর অজানা থেকে গেছিল, তা হচ্ছে বিঠোফেনের শ্রবণশক্তি তলানিতে গিয়ে ঠেকল কি করে। সেই প্রথম সুরের জাদুকরের এই শ্রবণগত দূর্বলতা প্রথম নজরে আসে। তার বধিরতার কারণ কি? এনিয়ে জল্পনার অন্ত ছিলনা। শরীর খারাপ লেগেই থাকত তার। পেটব্যথা, পেট ভরাভরা ভাব, ডায়রিয়া এইসব ছিল তার নিত্য সঙ্গী। চিররুগ্ন বিশ্ববন্দিত শিল্পী চলেও যান বড় তাড়াতাড়ি- মাত্র ছাপান্ন বছর বয়সে। তার বয়স তখন মাত্র তিরিশ, তখনই হতাশ বিঠোফেন পরিতাপ করে এক বন্ধুকে লিখলেন “প্রায় দুবছর ধরে আমি কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে পারছিনা। কাউকে জানাতেও পারবোনা তা কেন, কেন এমনই আমার দুরবস্থা। আমি কানে শুনিনা একফোঁটা। আমি অন্য কোন পেশায় থাকলে মানিয়ে নেওয়া যেত এই যন্ত্রনার সাথে। কিন্ত আমি যা কাজ করি তাতে এ এক অসহনীয় দুরবস্থা। আমার মনে হয় আমার যে কয়েকজন শত্রু আছে, তারাও বোধহয় এটা জানতে পেরে কষ্ট পাবেন”।
তার বয়স যখন ৩২ তখন বিঠোফেন দুঃখ করছেন “আমি বাঁশীর আওয়াজ শুনতে পাই না। কানে ঢোকেনা কোন রাখাল বালকের গানের কলি”। তিনি প্রায় বুক চাপড়ানোর মতো করে বলে চলেন- “এ কষ্ট আমি সইব কিভাবে? এরা আমাকে অসীম দুঃখের প্রান্তসীমায় এনে ফেলেছে। কখনও বা মনে হয় আমি আত্মহত্যা করি। শুধু সঙ্গীতই আমাকে পিছনে টানে। আমার মধ্যে যেটুকু আছে, সেটুকু এখনও উপুড় করে ঢেলে দেবার কাজ শেষ হয়নি আমার। ততদিনই, হ্যাঁ ততদিন এ পৃথিবী ছেড়ে যাবার কোন ইচ্ছে আমার নেই”।
১৮২৩ সালে আর একজন তারই মতো বধিরতাক্লীষ্ট পরিচিত ব্যক্তিকে তার কষ্টের কথা জানাতে গিয়ে বিঠোফেন লিখলেন “আমার মতো দুর্ভাগা কজন হয়! ডাক্তাররা খুব কমই জানে। শেষমেষ সবাই তাদের দেখে ক্লান্ত হয়ে পড়ে”।
বিঠোফেন তার শ্রবণেন্দ্রিয় ঠিক করার জন্য এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যার সমাধানের জন্য একের পর এক ডাক্তার দেখাতেন। যে যা চিকিৎসার কথা বলে যেতেন তাই তিনি প্রয়োগ করতেন। একটা সময় ছিল যখন তিনি ৭৫ রকমের ওষুধ খেতেন। একটা ওষুধই বোধহয় তাকে উদ্দীপ্ত রাখত- তার সঙ্গীত। নাইনথ সিম্ফনী বোধহয় বেরিয়ে এসেছিল এই কষ্টের গর্ভ থেকে। কেউ বলতো তার সিফিলিস হয়েছে, কেউ বা ডায়াবেটিস। এছাড়াও তার কষ্টের আরও নানা ডায়াগনসিস ছিল। প্যাজেটস ডিসিস অফ বোন, ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম, প্যানক্রিয়াটাইটিস প্রভৃতি। কিন্তু কারণের কোন বৈজ্ঞানিক সদুত্তর মেলেনি।
মিলল তার নাইনথ সিম্ফনীর প্রিমিয়ারের ২০০ বছর পর। এ বছর। কোথা থেকে? আমাদের রবি কবির মৃত্যুর পর তার চুল দাঁড়ি নিয়ে টানাটানি করেছিল কিছু অর্বাচীন মুর্খ। একই পরিণতি হয়েছিল বিঠোফেনের। নিমতলা ঘাটের অর্বাচীনরা অবশ্যই ভিয়েনায় মৃত্যু শয্যায় শুয়ে থাকা সুরস্রষ্টার চুল ছিঁড়ে রেখে দেওয়ার খবর পেয়েছিলেন- এমনটা ভাবার কোন কারণ ঘটেনি। কিন্তু পৃথিবীতে কালজয়ীরা এভাবেই ঘটনার সূত্রে বাঁধা পড়েন এক সুতোয়। বিঠোফেনের চুল নিয়ে যারা গেছিলেন তারা তা রক্ষা করেছিলেন এবং পরবর্তীতে সেগুলো সিন্দুক বন্দী হয়ে রাখা ছিল মিউজিয়ামে।
বিঠোফেন স্টাডি সেন্টারের মুখ্য উইলিয়াম মেরেডিথ এবং তার সহকর্মীরা শিল্পীর মাথার চুলের ডিএনএ-র পরীক্ষা শুরু করেন। কেভিন ব্রাউন বলে এক অস্ট্রেলীয় শিল্পপতির কাছে নীলামে কেনা বিঠোফেনের চুল তিনটি সিন্দুক রাখা ছিল। ব্রাউনেরও ইচ্ছা ছিল কেউ এগুলো পরীক্ষা করে বলে দিক বিঠোফেনের কি হয়েছিল? ব্রাউনও দুটো সিন্দুক পাঠান আমেরিকার মেয়ো ক্লিনিক-এ, যাদের বৈজ্ঞানিক ক্ষমতা ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সবই আছে। পরীক্ষা নিরীক্ষার ফল বেরোনর পর সবার চোখ আকাশে ওঠার মতো। বিঠোফেনের চুলে সীসের ঘনত্ব ২৫৮ মাইক্রোগ্রাম- প্রতি গ্রাম চুল (উর্দ্ধসীমা মাত্র চার)! বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত যে বিঠোফেন লেড পয়সনিং-এ আক্রান্ত হয়েছিলেন। তার চুলে আর্সেনিকের পরিমাণও স্বাভাবিকের থেকে ১৩ ভাগ বেশী। কাদের রিফাই, মেরেডিন, কোভিন ব্রাউন, সারা এরদাল এবং পল জেনেটো- এই পাঁচজন মিলে “জার্নাল অফ ক্লিনিক্যাল কেমিস্ট্রি”-র ৬ই মে প্রকাশিত সখ্যায় এই অনুসন্ধানের ফল প্রকাশ করেছেন।
এখন প্রশ্ন, তাহলে কি দীর্ঘকালীন লেড বিষক্রিয়ার প্রভাবেই বিঠোফেন-এর এত কষ্ট? তিনি বধিরও হয়েছিলেন এই ভারী ধাতুর শরীরে জমার ফলে। এই মাত্রারিক্ত সীসে তার শরীরে এলই বা কোথা থেকে? এখানেই কল্পনার প্রসার। আরও অনেক সৃজনশীল প্রতিভার মতো বিঠোফেনও ছিলেন গভীর মদ অনুরাগী। তিনি দিনে অন্ততঃ এক বোতল ওয়াইন খেতেন। তার অনেকটাই আবার সস্তার মদ। শেষ জীবনের দিকে মদ্যপানের পরিমাণও বেড়ে গেছিল। তিনি এও ভাবতে শুরু করেছিলেন যে মদ খেলে তার কষ্ট কমবে। এটা বহু মদ্যপায়ীও ভেবে থাকেন। মদের গুন এটাই। তার মৃত্যু শয্যাতেও তিনি চামচেতে করে মদ পান করতেন। তার প্রিয় মদ রুদে শেইমার তার বন্ধুরা তাকে ওষুধের মতো তুলে দিতেন। এক বন্ধু তাকে এই অবস্থায় ১২ বোতল ওয়াইন উপহার দিয়েছিলেন। চোখ মেলে তা দেখে প্রসন্ন মলিন হাসি হেসে বিঠোফেন বিড়বিড়িয়ে বলে উঠেছিলেন- “বড় দুঃখ, বড় যাতনা- এরা বড় দেরীতে এল”। বিঠোফেন যেন বহুদূর দেখেছিলেন। ১৮০২ সালে তিনি কামনা করেছিলেন তার এত কষ্টের কারণ তার মৃত্যুর পর যেন চিকিৎসকরা বের করতে পারেন। বিঠোফেনের কেশরাজি তার কষ্টের কারণের সন্ধান দিল দুশতক পরে। বিজ্ঞান অনেকদূর দেখতে পায়। শিল্প আর বিজ্ঞান মিললে তা যোজন দূর যায়।