দুঃখকে বোঝো, গ্রহণ করো, মানিয়ে নাও। তোমার যে অসুখ হয়েছে তাতে তোমার ক্রমশ চলার ক্ষমতা কমে যাবে, কথা বলতে অসুবিধা হবে, অসুবিধা হবে খাওয়া দাওয়া করতেও। তোমাকে এ পৃথিবী থেকে অন্যদের থেকে একটু আগেই চলে যেতে হতে পারে। এগুলোই বাস্তব, তাই মোটর নিউরোন ডিসিস নামের নার্ভের অসুখে আক্রান্তদের এমন কথা প্রায়ই শুনতে হয়। শুনতে না চাইলেও, কানে এসে পড়ে, চোখে পড়ে। আর এখন ‘গুগল’ নামের ‘পন্ডিত’ বিশ্ববীক্ষার যে আখড়া খুলে বসে থাকেন সেখানে রোগচর্চা করতে গেলে কান মাথা গরম হওয়া অবশ্যম্ভাবী। যেকোন মুহুর্তে এই দৃঢ় ধারণা হতে পারে সেই মানুষদের, যাদের সত্যি সত্যি অসুখ আছে, তবে আর “এ পৃথিবীতে থেকে লাভটা কি?”। এমন ভাবনা যে হয়না অনেকের তাও নয়। ব্যক্তিত্ব যাদের পলকা, জীবন-ভাবনা যাদের একটু নেতির দিকে মূলগতভাবেই হেলে থাকা- তারা এরকম রোগ হয়েছে জানতে পারলে আত্মহননের পথও কখনও বা বেছে নেন। মোটর নিউরোন ডিসিস-এর একটিমাত্র ওষুধ আছে এখনও। তাতে জীবনের প্রতিদিনের কাজকম্ম এবং জীবনধারণের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানোর জন্য পেশী এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গের যে শক্তি দরকার, তার ক্রম অবনমন বেশী দিন রোধ করা যায় না। জীবনের গুণগত মানও বাড়ে অল্প কিছু সময়ের জন্য। সবমিলিয়ে বিজ্ঞান এখনও এই স্নায়ুক্ষয়রূপী রোগের কোন কার্যকারী ওষুধ এবং ভালো রাখার প্রক্রিয়া বার করতে পারেনি। মনকে সদর্থক ভাবনার জোরেই শুধু ভালো রাখা যায়। স্টিফেন হকিং এভাবেই ষাট বছর কার্যকরী এবং সৃষ্টিশীল জীবন কাটিয়েছিলেন। তারও এই অসুখ ছিল। স্টিফেন হকিং মহাকাশেও যেতে চেয়েছিলেন। সেটা আর তার হয়ে ওঠেনি। আত্মশ্রদ্ধা, একান্তই নিজের উপর নির্ভতার মানসিকতা, আমি একাই পারব- এই দৃঢ়তা, “সমস্যা হয়েছে তো কি হয়েছে!” এই মানসিকতা নিয়েই সারা জীবন কাটিয়ে দেন তিনি। শুধু কাটিয়ে দিয়েছেন বললেই ভুল বলা হবে। শেষমুহুর্ত পর্যন্ত সৃষ্টিশীল কাজকর্মগুলোকে গতিশীল রেখেছিলেন স্টিফেন হকিং, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও। হয়তো এটাই প্রেরণা ছিল ইংল্যান্ডের সেই চিকিৎসক-বিজ্ঞানীদের যারা র্যান্ডমাইজড কন্ট্রোল্ট ট্রায়াল করে সম্প্রতি দেখতে চেয়েছিলেন যে “অ্যাক্সেপটেন্স এন্ড কমিটমেন্ট” থেরাপি (এ এস টি), যা অনেকটাই হকিং এর জীবনের ছায়ারেখার মতো, তাতে মোটর নিউরোন ডিসিস-এর রোগীদের জীবনের গুণগত মান উন্নত হয় কিনা?
উত্তর যা পাওয়া গেছে তা অত্যন্ত সদর্থক।
৯ই মে ল্যানসেট-এ প্রকাশিত গবেষণা পত্রে রেবেকা গোল্ড এবং তার সহকর্মীরা ইংল্যান্ডের ১৬টি এমএনডি ক্লিনিক-এর ১৯১ জন রোগীকে দুটি ভিন্ন পদ্ধতিতে চিকিৎসা করে তার তুলনামূলক ফল দেখেন। একদলকে “অ্যাক্সেপটেন্স অ্যান্ড কমিটমেন্ট”-র সাথে সাধারণত যা করা হয়, তাই করা হয়েছিল। অন্য দলকে সাধারণত যা করা হয় সেই চিকিৎসাতেই রাখা হয়েছিল। দু’দলের মধ্যে জীবনের গুণগত মানের ফারাক হয় কিনা তা দেখার লক্ষ্য ছিল। গবেষকরা দেখতে পান যে, গ্রুপ-এ অর্থাৎ এসিটি-তে যা করা হয় সেটা করে রোগীরা অনেকটা বেশি ভালো থাকেন অন্য গ্রুপের তুলনায়। ফলের হিসাব তারা করেছিলেন চিকিৎসা শুরুর ন’মাসের মাথায়। “অ্যাক্সেপটেন্স অ্যান্ড কমিটমেন্ট” থেরাপির ভিত্তিই হচ্ছে মানসিক নমনীয়তা এবং যা চলে যাবেনা, তাকে গ্রহণ করার প্রস্তুতি। নিজের ভাবনাকে সত্যের সাথে ঘসে মেজে নিয়ে তৈরী করা ঝড় তুফানের মধ্যে জীবন কাটানোর মানসিকতাকে দৃঢ় করা। খুব সহজ নয় অবশ্যই। আর তড়িঘড়ি ওষুধ খাবো আর অসুখ ভালো হয়ে যাবে, এই আধুনিক মানসিকতার প্রেক্ষিতে বেশ কঠিনই। তবুও এই ফলিত গবেষণার ফল আশাপ্রদ।
রবি কবি তো বহু আগেই গেয়ে গেছেন- “মেঘ দেখে তুই করিস নে ভয় আড়ালে তার সূর্য হাসে”