সূর্যে এখন মহাপ্রলয়ের লগ্ন। দশ কোটি মাইল দূরে থাকা অগ্নিগোলক রবিরশ্মির বিকিরণের ঝলক এই মুহুর্তে পৃথিবীর অনেক অংশের আকাশে দেখা যাচ্ছে। এমনটা সচরাচর ঘটেনা। মহাপ্রলয়ের ছটার অপরূপ দৃশ্য আকাশকে করে তুলছে নানা রঙ্গে রঙীন। সাধারণত যা শুধু দেখা যায় মেরুর কাছাকাছি দেশগুলির আকাশে, সেই অরোরা বোরিয়ালিস বা ‘নর্দান লাইট’ দেখার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের বহু দেশে। সাথের ছবিটি সানফ্রান্সিস্কো থেকে দেখা।
পৃথিবী বর্তমানে দুদশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী সৌরঝড়ের সম্মুখীন হচ্ছে। ন্যাশানাল ওশিয়ানিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফেয়ারিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশান (NOAA)-এর স্পেস ওয়েদার প্রেডিকশান সেন্টার ঘটনাটিকে একটি G5 হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করেছে। ভূচৌম্বকীয় ঝড় স্কেলে এটি সর্বোচ্চ স্তর। প্রলয়ের শুরু বুধবার সকাল থেকে। সূর্যের বুকে একটি বড় সানস্পট ক্লাস্টার বুধবার সকাল থেকে বেশ কয়েকটি মাঝারি থেকে শক্তিশালী সৌর শিখা তৈরি করেছে। সানস্পটগুলি হল সূর্যের পৃষ্ঠের অস্থায়ী দাগ যা আশেপাশের এলাকার চেয়ে গাঢ়। দুটি বিশাল সানস্পট সম্প্রতি একত্রিত হয়েছে যা পৃথিবীর ব্যাসের প্রায় ১৭ গুণ। এই অঞ্চলগুলি থেকেই সৌরশিখা বেরোচ্ছে এবং ক্রমাগত ঘটে চলেছে বিস্ফোরণ। এর থেকেই তৈরী হয়েছে সৌর বিকিরণ ঝড়। সৌর বিকিরণ ঝড় হয় যখন একটি বড় মাপের চৌম্বকীয় বিস্ফোরণ ঘটে, প্রায়শই যা করোনাল মাস ইজেকশন (CME) তৈরী করে এবং এর সাথে সম্পর্কিত সৌর শিখার সৃষ্টি করে। বর্তমানে কমপক্ষে পাঁচটি CME সৌর ঝড়ের সাথে যুক্ত যা পৃথিবীর দিকে ধাবমান বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
সৌরবিকিরণ ঝড় সৌরবায়ুমণ্ডলে চার্জযুক্ত কণাগুলিকে খুব উচ্চবেগে ত্বরান্বিত করে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কণা হল প্রোটন যা বহুলাংশে আলোর গতিবেগে ত্বরান্বিত হতে পারে। সাধারণ অবস্থায় প্রোটন পৃথিবীর চুম্বকক্ষেত্র ভেদ করতে সক্ষম হয় না। কিন্তু উচ্চ গতিবেগ পাওয়ার ফলে প্রোটনগুলি সূর্য থেকে পৃথিবীতে আসতে সময় নেয় মাত্র ১০ মিনিট বা তারও কম। দ্রুত চলমান প্রোটনগুলি পৃথিবীর চৌম্বকমণ্ডলের ভিতরে প্রবেশ করে। কণাগুলি চৌম্বকক্ষেত্রের রেখার নীচে পরিচালিত হয় এবং উত্তর ও দক্ষিণ মেরুগুলির কাছাকাছি বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে থাকে নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন গ্যাস। অক্সিজেনের সঙ্গে এই প্রোটনের সংঘর্ষে সবুজ আলো ও নাইট্রোজেনের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে বেগুনি, নীল ও গোলাপী আলো দেখা যায় আকাশে। এই কারণেই সৌরঝড় চলাকালীন অরোরা বোরিয়ালিস দৃশ্যমান হয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে। সৌরবিকিরণ ঝড় সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা প্রথম জানতে পারেন ১৮৫৯ সালে। ঐ বছরের ১লা সেপ্টেম্বর সৌর জ্যোতির্বিজ্ঞানী রিচার্ড ক্যারিংটন তার ব্যক্তিগত অবজারভেটরির টেলিস্কোপের মাধ্যমে ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেন। তিনি সেই সময়ে সূর্যের দাগগুলি স্কেচও করেছিলেন৷ সেই থেকে এই সৌর বিকিরণ ঝড়ের নামকরণও হয়েছিল এই ক্যারিংটন সাহেবের নামে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে সৌরশিখার সংখ্যা আনুমানিক প্রতি ১১ বছরে বৃদ্ধি পায়। ২০১৩ সালের পর ২০২৪ সালে আবার এটি দেখা যাচ্ছে। একটি সৌর বিকিরণ ঝড় কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত চলতে পারে। আমাদের কাছে এখনও পরিষ্কার নয় এবারের কবে পর্যন্ত চলবে।
আকাশে নানা রঙের খেলা ছাড়াও এই সৌরপ্রলয়ের প্রভাবে পৃথিবীতে নানান ঘটনা ঘটতে পারে। যখন মহাকাশে স্যাটেলাইট বা মানুষের সাথে শক্তিশালী প্রোটনের সংঘর্ষ হয়, তার গভীরে প্রবেশ করতে পারে এবং ইলেকট্রনিক সার্কিট বা জৈবিক ডিএনএর ক্ষতি করতে পারে। আরও চরম সৌরবিকিরণ ঝড়ের সময়, উচ্চ অক্ষাংশে উড়ন্ত বিমানের যাত্রী ও কর্মীদের বিকিরণ সংক্রান্ত ঝুঁকি হতে পারে। এছাড়াও যখন শক্তিশালী প্রোটনগুলি বায়ুমণ্ডলের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, তখন তারা পরমাণু এবং অণুগুলিকে আয়নিত করে মুক্ত ইলেকট্রন তৈরি করে। এই ইলেকট্রনগুলি আয়নোস্ফিয়ারের নীচের দিকে একটি স্তর তৈরি করে যা উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সি রেডিও তরঙ্গ শোষণ করে রেডিও যোগাযোগকে ব্যাহত করবার ক্ষমতা রাখে। এছাড়া বৈদ্যুতিক পাওয়ার গ্রিড, নেভিগেশন, রেডিও এবং স্যাটেলাইট কর্মক্ষমতাগুলিও হ্রাস পেতে পারে সৌরঝড়ের কারণে।
সূর্যের আলো এবং উত্তাপ নিয়েই পৃথিবী বেঁচে আছে। সূর্যের প্রলয়ের ঢেউ যে পৃথিবীতে এসে পড়বে সেটাই বাস্তব। কিন্তু জ্যোতির্মন্ডলের স্নেহশীল পিতা তার সবথেকে প্রিয় গ্রহকে আলো দিয়ে যাবে বছর বছর জুড়ে এই আশায় বুক বেঁধেই আমরা বেঁচে আছি। নজর থাকুক আগামী কয়েকদিনের দিকে।
১১ই মে ২০২৪
ছবি সৌজন্য: শরণ্যা মজুমদার