প্রাচীন বই নাড়াচাড়া থেকে বিষক্রিয়া

প্রাচীন বই নাড়াচাড়া থেকে বিষক্রিয়া

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা‌
Posted on ৩০ এপ্রিল, ২০২৪

আমাদের আধুনিক সমাজে, বইকে আমরা সচরাচর বিপজ্জনক বস্তু হিসেবে বিবেচনা করিনা। তবে এক নতুন গবেষণা থেকে জানা যায় যে কিছু বইয়ের উপাদান এতটাই বিপজ্জনক যে সেগুলোকে পাবলিক লাইব্রেরি, বইয়ের দোকান, এমনকি বাড়ির বইয়ের আলমারির তাকে রাখার আগে যাচাই করা প্রয়োজন। উইন্টারথার মিউজিয়াম, গার্ডেন অ্যান্ড লাইব্রেরি এবং ডেলাওয়্যার ইউনিভার্সিটির একটি সহযোগিতামূলক গবেষণা প্রকল্প, দ্য পয়জনাস বুক প্রজেক্ট, এই ধরনের বইয়ের তালিকা তৈরি করছে। পৃষ্ঠাগুলোর লিখিত বিষয়বস্তু নিয়ে গবেষকদের উদ্বেগ নয়, তারা চিন্তিত বইয়ের নিজস্ব উপাদান, বিশেষত, কভারের রঙ নিয়ে৷ সম্প্রতি প্রকল্পটি ফরাসি জাতীয় গ্রন্থাগার থেকে দুটি বই সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। তারা সন্দেহ করছেন বইয়ের ঝকঝকে সবুজ কাপড়ের আবরণে আর্সেনিক থাকতে পারে। এই উদ্বেগ বই বাঁধাই করা বা বুকবাইন্ডিংয়ের ঐতিহাসিক অনুশীলনের মধ্যে নিহিত। উনিশ শতকে, যখন ব্যাপকভাবে বই প্রকাশিত হতে শুরু করে, বুকবাইন্ডাররা দামী চামড়ার কভার ব্যবহার না করে আরও সাশ্রয়ী মূল্যের কাপড় বই বাঁধাইয়ের জন্য ব্যবহার করতে শুরু করে। পাঠকদের আকৃষ্ট করার জন্য, এই কাপড়ের কভারগুলো প্রায়শই উজ্জ্বল, নজরকাড়া রঙে রঞ্জিত হত।
শেলিজ গ্রিন একটি জনপ্রিয় রঞ্জক হিসেবে পরিচিত ছিল যার নামকরণ করা হয়েছিল জার্মান-সুইডিশ রসায়নবিদ কার্ল উইলহেম শেলের নামে। ১৭৭৫ সালে শেল আবিষ্কার করেন তামা এবং আর্সেনিক থেকে একটি উজ্জ্বল সবুজ রঞ্জক তৈরি করা যেতে পারে যা শুধু যে সস্তা তা নয়, এটির রঙ এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ব্যবহৃত কপার কার্বনেট সবুজের চেয়েও বেশি প্রাণবন্ত, উজ্জ্বল। তবে সময়ের সাথে সাথে এই রঞ্জকটি কালো হয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখায়। ফলত, এই আবিষ্কারের উপর ভিত্তি করে নতুন রঞ্জক, যেমন প্যারিস গ্রিন, অনেক বেশি টেকসই বলে প্রমাণিত হয়েছে। এই রঞ্জক, বইয়ের কভার, পোশাক, মোমবাতি এবং ওয়ালপেপার সহ বিভিন্ন বস্তুতে ব্যবহারের জন্য দ্রুত গৃহীত হয়েছিল।
তবে এই রঞ্জকগুলোর ব্যবহারের বেশ কিছু ক্ষতিকারক দিক ছিল: এগুলো সহজেই নষ্ট হয়ে যায় এবং বিষাক্ত কার্সিনোজেনিক আর্সেনিক নির্গত করে। সেই সময় ক্রিসমাস পার্টিতে সবুজ মোমবাতি ব্যবহারের কারণে শিশুদের বিষক্রিয়া, কারখানার কর্মীদের অলঙ্কারে রঞ্জক লাগানো, বা মহিলাদের গাউনের সবুজ রঙ থেকে বিষক্রিয়া তাদের সুরক্ষ সম্বন্ধে গুরুতর উদ্বেগ তৈরি করেছিল। এই ঘটনাগুলো এতটাই কুখ্যাত হয়ে ওঠে যে ১৮৬২ সালে, ‘পাঞ্চ’ নামক একটি ম্যাগাজিন “দ্য আর্সেনিক ওয়াল্টজ” শিরোনামে একটি কার্টুন প্রকাশ করে, যেখানে সেই সময়ের ফ্যাশনকে ঘিরে ব্যাঙ্গ করে দেখানো হয় কিছু কঙ্কাল নৃত্য করছে।
তবে, শুধুমাত্র সবুজকে ঘিরেই উদ্বেগ গড়ে ওঠেনি। লালও চিন্তার কারণ ছিল। উজ্জ্বল সিঁদুর লাল রঞ্জকটি মারকারি সালফাইড নামেও পরিচিত। এটি হাজার হাজার বছর আগে লাল রঙের একটি জনপ্রিয় উৎস ছিল। এমনকি বলা হয় যে নিওলিথিক যুগে শিল্পীরা পারদের বিষক্রিয়ায় ভুগছিলেন। কখনও কখনও বইয়ের কভারের ভিতরে সিঁদুর লাল প্যাটার্ন দেখা যেত।
হলুদ রঙের ক্ষেত্রে অপরাধী হল লেড ক্রোমেট। লেড ক্রোমেটের উজ্জ্বল হলুদ রঙ চিত্রশিল্পীদের কাছে জনপ্রিয় ছিল। ভিনসেন্ট ভ্যান গগ এই রঙটিকে ‘সানফ্লাওয়ার’ নামের তার সবচেয়ে বিখ্যাত সিরিজের পেইন্টিংগুলোতে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছিলেন। ভিক্টোরিয়ান যুগের বুকবাইন্ডারা লেড ক্রোমেটের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন রঙ ব্যবহার করে সবুজ, হলুদ, কমলা এবং বাদামী রঙ তৈরি করত। সীসা এবং ক্রোমিয়াম উভয়ই বিষাক্ত। তবে সবুজ এবং লালের চেয়ে হলুদ রঙ কম উদ্বেগের বিষয় ছিল। তবে লেড ক্রোমেট দ্রবণীয় নয়, তাই এটি শোষণ করা কঠিন। ফলত এটি এখনও একটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত রঞ্জক। যারা নিয়মিত এই বইগুলো নাড়াচাড়া করেন তাদের ক্ষেত্রে এটি উদ্বেগের বিষয় কারণ এদের গুরুতর লক্ষণ দেখা দিতে পারে। অতএব, কেউ যদি ভিক্টোরিয়ান যুগের একটি সবুজ রঙের বাঁধাই করা বই নাড়াচাড়া করেন তবে তাদের গ্লাভস ব্যবহার করতে হবে এবং কোনোভাবেই হাত দিয়ে মুখ স্পর্শ করা চলবে না। বই ব্যবহারের পর হাত মুখ ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করতে হবে।