কিছু কিছু বিজ্ঞানীর মতে বহু বহু বছর আগে ধূমকেতু ধীর গতিতে কিন্তু প্রাণঘাতী রূপে ডাইনোসরদের উপর আঘাত হেনেছিল, নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল তাদের অস্তিত্ব। আজ এত বছর পরে ঠিক ততটাই মারাত্মকরূপে মানুষের বিবিধ কার্যকলাপ গাছেদের থেকে প্রাণীদের ছিনিয়ে নিচ্ছে। এক নতুন গবেষণাপত্রে পরিবেশবিদরা সতর্ক করেছেন যে বিশ্বব্যাপী বিবর্তনের এই গতিপথ পরিবর্তন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে যে মানুষের জীবন ধীরে ধীরে বিপন্ন হয়ে উঠবে। গত কয়েক মাসে ষষ্ঠ গণবিলুপ্তি ভয়াবহভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। ব্যাপকহারে সামুদ্রিক পাখির মৃত্যু ঘটছে, উপকূলবর্তী অঞ্চলে মৃত মাছের ঝাঁক দেখা যাচ্ছে, অতিরিক্ত তাপপ্রবাহের ফলে অ্যালগাল ব্লুমে সি-লায়নদের বিষক্রিয়া ঘটছে, গত বছরে পেঙ্গুইনরা প্রজনন করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং সাম্প্রতিককালে গবেষকরা দেখেছেন কীটপতঙ্গের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। তাই মেক্সিকোর ন্যাশনাল অটোনোমাস ইউনিভার্সিটির বাস্তুবিজ্ঞানী জেরার্ডো সেবেলোস এবং স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির সংরক্ষণ জীববিজ্ঞানী পল এহরলিচ মিলে ১৫০০ সিই থেকে প্রজাতির বিলুপ্তি মূল্যায়ন করেছেন এবং বিগত ৫০০ মিলিয়ন বছরের সাথে তুলনা করেছেন। তারা দেখেছেন বিগত ৫০০ বছরে মোট ৭৩টি মেরুদণ্ডী প্রাণী বিলুপ্তির পথে এগিয়ে গেছে। জীববিজ্ঞান ভিত্তিক শ্রেণীবিন্যাসের অনুক্রমে জেনাস বা গণ, প্রজাতির ঠিক উপরে বিরাজ করে এবং সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত জীব এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। বিলুপ্তির এই হার আগের গণ-স্তরের বিলুপ্তির চেয়ে ৩৫ গুণ বেশি। মানুষের প্রভাব না থাকলে, একই সংখ্যক জেনাস-স্তরের প্রাণীদের শেষ হতে ১৮,০০০ বছর লেগে যেত। অন্যান্য গবেষণায় উদ্ভিদ, ছত্রাক এবং অমেরুদণ্ডী প্রাণীর জন্যও একইভাবে অনেক বেশি মাত্রায় বিলুপ্তির হার পাওয়া গেছে।
যে জীবজগতে আমরা বাস করি তা আন্তঃসংযুক্ত, তাই একটি প্রজাতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে তার প্রভাব সমগ্র জীবজগতে পড়বে। সেবেলোস এবং এহরলিচের মতে মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীরা একসাথে একটি স্থিতিশীল বৃক্ষের শাখাপ্রশাখার মতো বিকাশ লাভ করেছে, তাই কোনো প্রজাতির দ্বারা সম্পাদিত পরিবেশগত ক্রিয়াকলাপ সরাসরি মানুষের উপরও প্রভাব ফেলছে। উদাহরণস্বরূপ, মধ্য আমেরিকায় ম্যালেরিয়া সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে কারণ মশা-ভোজনকারী ব্যাঙেরা সেখানে কমে যাচ্ছে। গবেষকেরা সতর্ক করেছেন এই গতিতে অগ্রসর হলে ২১০০ সালের মধ্যে সমস্ত বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। লক্ষ লক্ষ বছরের বিবর্তনের ইতিহাস হারিয়ে যাবে আর কখনও তা পুনরাবৃত্তি করা যাবে না, সেইসাথে তাদের দ্বারা সঞ্চালিত কাজ যা সম্মিলিতভাবে জীবন চক্রকে একটি মেশিনের মতো চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিলুপ্ত জীবের জন্য কার্যকরী প্রতিস্থাপন সৃষ্টি করতে বিবর্তনের লক্ষ লক্ষ বছর প্রয়োজন। পৃথিবীর বুকে জলবায়ু পরিবর্তন একাই ব্যাপকভাবে ক্ষতি করছে, সঠিক সময়ে পরাগায়ন হচ্ছে না, বিভিন্ন প্রজাতি হারিয়ে যাচ্ছে, এবং নতুন নতুন আক্রমণাত্মক প্রজাতির প্রাণী ছড়িয়ে পড়ছে। পরবর্তী দু দশকে পৃথিবীর বুকে যা ঘটবে তা সম্ভবত জীববৈচিত্র্য এবং মানুষের ভবিষ্যতকে সংজ্ঞায়িত করবে।