বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চা: ঐতিহ্য ও সতর্কতা
(বিশিষ্ট পদার্থবিদ ও বিজ্ঞানলেখক, এবং ভাষাতাত্ত্বিক অধ্যাপক পলাশ বরন পালের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন চিকিৎসক ও বিজ্ঞানভাষ-এর প্রধান সম্পাদক ডাঃ অভিজিৎ চৌধুরী)
ডাঃ চৌধুরী: বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চার এক শক্তিশালী ঐতিহ্য আছে। বহু মানুষ এই বিষয়টি নিয়ে চর্চা করছেন; এই চর্চার যে প্রবাহ, তার আঙ্গিক, এবং সেটাকে কীভাবে আমরা আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষমতার মধ্যে প্রয়োগ ঘটাব, সেই প্রবাহে আমরা শরিক হতে চাই, আর সেই শরিক হওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের কোন কোন বিষয়গুলির দিকে নজর দেওয়া দরকার, কোন কোন ভাবনার জায়গাগুলোতে সঠিক হওয়া দরকার, সেই নিয়েও আলোচনা করব আমরা।
প্রথমেই আপনার কাছে জানতে চাইব, বাংলায় বিজ্ঞানলেখায় একটা একটা আলোচনায় প্রায়ই উঠে আসে যে (কোনও লেখার মধ্যে) বিষয়ের গভীরতা, বা মেটিকুলাসনেস; আর সাবলীল এবং সরল ভাষায় সেটাকে উপস্থাপন করতে গিয়ে, অর্থাৎ সামঞ্জস্য রাখতে গিয়ে অনেকসময় দেখা যায় কোনও একটা দিক টলে পড়ে। তো আগামী দিনে যাঁরা বিজ্ঞান নিয়ে লিখতে আসবেন, বিজ্ঞানলেখক হবেন; তাঁরা এই সামঞ্জস্য রাখবার ক্ষেত্রে কেমনভাবে ভাবনাচিন্তা করতে পারলে এটা পারফেক্ট করে তুলতে পারবেন? কারণ বিজ্ঞান কখনও ‘লেস দ্যান পারফেক্ট’ হতে পারে না বলে আমার বিশ্বাস।
অধ্যাপক পাল: আপনি অনেকগুলো বিষয় বললেন, একটা হচ্ছে বিষয়ের গভীরতা আর একটা উপস্থাপনার সাবলীলতা, এই দুটো আলাদা আলাদা করে আলোচনা করার বিষয়। আমি উপস্থাপনার সাবলীলতার কথাটা আগে একটু বলে নিই, তারপর বিষয়ের গভীরতা নিয়ে পরে বলব আমার যেরকম যা মনে হয়েছে।
উপস্থাপনার সাবলীলতার বিষয়ে আমার যেটা মনে হয়, লোকের কীরকম একটা ধারণা আছে যে সকাল বেলা বাজারে গিয়ে আলু পটল কিনতে গেলে অভিধানের যেটুকু অংশ ব্যবহার করতে হয়, সেটুকু অংশ ব্যবহার করেই বিজ্ঞান-আলোচনা করা যাবে। এই প্রত্যাশার কোনও অর্থ নেই, কোনও ভাষাতেই এই প্রত্যাশা পূরণ হয় না। বিজ্ঞান আলোচনা করতে গেলে, ধরুন পদার্থবিদ্যা যারা পড়ে। তাদের প্রায় প্রত্যেকেকেই কলেজের প্রথম ক্লাসে যেটা পড়তে হয়, সেটা হচ্ছে নিউটনের তিনটে সূত্র, তার মধ্যে প্রথমেই একটা কথা আসে— ‘ভেলোসিটি’। ‘ভেলোসিটি’ কথাটা ইংরেজিতে কোনওদিনই কথ্যভাষায় ব্যবহার হয় না, এমনকি অভিধানেও সেটা একটা অপ্রচলিত শব্দ হিসেবে চিহ্নিত থাকে। কাজেই এইরকম কিছু কথা আছে যেগুলো ব্যবহার করতেই হবে। আর তাহলে এইগুলোর কিছুই ব্যবহার করা হবে না, আমি ওই আলু-পটলের অভিধান নিয়ে বিজ্ঞান বলব, এটা হবে না। এটা হওয়া উচিত নয়, আর হলেও সেটা আর বিজ্ঞান নয়।
কিন্তু লোকের যেমন একটা প্রত্যাশা থাকে যে আমি বাংলা পড়ছি, এ আমার নিজের ভাষা, অতএব তার সমস্ত কথাই আমাকে ঝটঝট করে বুঝে ফেলতে হবে; এ হয় না। কিছু পারিভাষিক শব্দ থাকবে, সেই পারিভাষিক শব্দগুলো যিনি ব্যবহার করছেন তাঁর দায়িত্ব থাকে সেগুলোকে ব্যাখ্যা করে দেওয়া। তবে ব্যাখ্যা করে দেওয়া মানে পাশে ব্র্যাকেটে ইংরেজিতে লিখে দেওয়া নয়। কারণ যিনি পড়ছেন তিনি সেই ইংরেজি শব্দটা জানেন না এটাই ধরে নিয়েই এগোতে হবে।
ধরুন আমি যদি আজকে বলি যে ‘উইক ইন্টার্যাকশন’, এর বাংলা নানাজনে নানানভাবে করেছেন, আমি নিজের লেখায় যে বাংলাটা লিখতে পছন্দ করি, সেটা হচ্ছে ‘লঘু বল’। এখন ‘লঘু বল’ লিখে যদি পাশে ব্র্যাকেটে ‘উইক ইন্টার্যাকশন’ লিখে দিই, তবে যিনি ওটা পড়ছেন তাঁর পদার্থবিদ্যায় সেইরকম কোনও শিক্ষণ বা চর্চা আছে এমনটা না-ও হতে পারে। তিনি ওটা দেখেই কি বলবেন, ওহ উইক ইন্টার্যাকশন! ও তো ছোটবেলা থেকেই আমি জানি। সেটা তো আর নয়। কাজেই পাশে ব্র্যাকেটে ইংরেজিতে লিখে দেওয়া মানেই ব্যাখ্যা করা নয়। ব্যাপারটা তো বুঝিয়ে দিতে হবে। কিন্তু এইরকম যে পারিভাষিক শব্দ, এগুলো প্রায় সবসময়েই একটু ভারী শব্দ হয়। ভারী শব্দ হওয়ার কারণ হচ্ছে পৃথিবীর সমস্ত বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে কথ্য ভাষার শব্দ দিয়ে বর্ণনা করা যায় না কারণ সেখানে আলাদা আলাদা নানান জিনিসের মধ্যে তফাৎ করতে হয়, তাই বেশি শব্দ লাগে। সেই জন্য কিছু শক্ত কিছু শব্দের দরকার হয়। এটাকে মেনে নিতে হবে। এইটা আমাদের একটা মানসিক প্রস্তুতি, এটা আমাদের অনেক সময়ে থাকে না বলেই কেউ একটা যা খুশি লিখলেই লোকে লেখাটা পড়ে বলেন, ওহ আপনার একটা লেখা পড়ে আমার তিনটে দাঁত কালকে ভেঙে গেল, এখন ডেন্টিস্টের কাছে ছুটতে হবে!
এখন এইসমস্ত কথা বলে কোনও লাভ নেই। ইংরেজিতে যিনি ‘ডিফ্র্যাকশন’ (আলো বা সব ধরনের তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের এক বিশেষ ধর্ম, যেখানে কোনও তীক্ষ্ণ বস্তুপ্রান্তের পাশ দিয়ে ওই তরঙ্গ যাওয়ার সময় দিক পরিবর্তন করে— অনুলেখক) পড়েন, তাঁরও ওই শব্দটা পড়ে তিনটে দাত ভেঙে যেতে পারে। কারণ ‘ডিফ্র্যাকশন’ কথাটা কোনদিন কোত্থাও … আপনি যদি একটা ইংরেজিভাষী শহরে গিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাউকে বলেন ‘আই ওয়ান্ট টু ডু ডিফ্রাকশন’, সে হয়তো পুলিশে খবর দেবে! কারণ সে ভাববে আপনি বোধ হয় তার কিছু একটা অপকার করতে যাচ্ছেন। কাজেই এগুলোর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
এ গেল একটা দিক। দ্বিতীয় যেটা আপনি বললেন সেটা হচ্ছে বিষয়ের গভীরতা। দেখুন, সেটা আনতে হলে যেটা করা দরকার, সেটা হচ্ছে যে বিষয়টা সম্বন্ধে আপনার প্রাথমিক বা সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার। আপনি আর দুজনের খবরের কাগজে লেখা রিপোর্ট পড়লেন, আর তারপর আপনিও লিখলেন… এটা যে সবসময় করতে হয় না এটা আমি বলছি না, তবে এটা যথেষ্ট নয়। নিজের একটা বোধ থাকা দরকার বিষয়টা সম্বন্ধে। এখন আপনি যদি বিজ্ঞান সাংবাদিকতার কথা বলেন, সাংবাদিক যে বিজ্ঞানের সবকিছু জানবেন এটা তো হতে পারে না, এমনকি আমাকেও যদি পদার্থবিদ্যার অনেক প্রশাখা সম্বন্ধে প্রশ্ন করেন, আমি সেখানে কিছুই জানি না। যদিও আমি পদার্থবিদ্যার কোনও না কোনও প্রশাখায় পুরোভাগের যে গবেষণা, সেই গবেষণার কাজে তো রয়েছি। কিন্তু তা হলেও সমস্ত শাখার যে খবর আমি জানি তা তো নয়। কাজেই সাংবাদিকের পক্ষেও সমস্ত কিছু জানা সম্ভব নয়। কিন্তু তাঁকে যেটা করতে হবে, সেটা হচ্ছে উপযুক্ত লোক খুঁজে, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে ব্যাপারটা সম্বন্ধে খানিকটা বোধ তৈরি করার চেষ্টা করতে হবে। এখন এইখানে মুশকিল হচ্ছে যে অনেক সময় উপযুক্ত লোকের অভাব হতে পারে কেননা বাংলায় যখন লিখছেন তখন বাংলা জানেন এইরকম বিজ্ঞানীকে তাহলে তাঁকে খুঁজতে হবে। সমস্ত বিষয় সেরকম চটজলদি কাউকে পাওয়া না-ও যেতে পারে, পাওয়া গেলেও তাঁর সময় না-ও হতে পারে, সময় হলেও তিনি নিজে বাংলাতে বলতে হয়তো অভ্যস্ত নন; তিনি গবেষণাপত্র লিখে এসেছেন ইংরেজিতে, কাজেই তাঁকে বললেই তিনি যে ঝটাঝট করে বাংলায় ফরফর করে বলতে শুরু করবেন এটা আশা করারও কোনও কারণ নেই। এরকম কিছু অসুবিধা তো থাকেই। এই অসুবিধাগুলো মেনে নিয়েই চলতে হবে। এখন কেউ কেউ বলবেন কেন ইংরেজি শব্দগুলো পরিভাষায় লিখে দিলেই তো ঝামেলা চুকে যায়, সেইটাই আমাদের করা উচিত— এই কথার কোনও অর্থ নেই। এ না ভেবেচিন্তে বলা কথা। কেন না, এ আপনি কোথায় থামবেন। আপনি কি সমস্ত, ধরুন আমার একটা লেখার মধ্যে ছিল রাসায়নিক মৌলের কথা। এখন আপনি টাংস্টেন বা নিকেল এগুলো ইংরেজি নাম ব্যবহার করবেন, তাতে তো কেউ আপত্তি করবেন না, নিশ্চয়ই করবেন। কিন্তু এমনকি অক্সিজেন হাইড্রোজেন এগুলোর ক্ষেত্রেও আপনি ইংরেজি নাম ব্যবহার করবেন। আর ইংরেজি কথা যদি ব্যবহারও করেন, ইংরেজিতেও তো সিলভার কথাটা অনেক সময়েই বিজ্ঞানের পরিভাষায় ব্যবহৃত হয় না, বা ধরুন লোহা, লোহার ক্ষেত্রে আয়রন কথাটা তো প্রায় কখনওই ব্যবহার হয় না। রাসায়নিক যৌগের নাম ফেরিক অক্সাইড, ফেরাস অক্সাইড— এরকম করে হয়। তাহলে কি ফেরাম ব্যবহার করতে হবে? কাজেই এর কোনও শেষ নেই, আপনি কোথায় গিয়ে থামবেন ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে? এখন শেষ পর্যন্ত যদি আপনাকে বাংলায় বলতে গিয়ে ওইরকম একটা বাক্য বলতে হয় যেখানে আমি মাঝে মাঝে উদাহরণ দিই যে ‘একটা কনটেনারের মধ্যে খানিকটা লিকুইড নিয়ে তার টেমপারেচার এবং প্রেশারের মধ্যে ভ্যারিয়েশন যদি কনসিডার করা হয় তাহলে আমরা যে রেজাল্ট পাব’— এরকম যদি বলতে হয় তাহলে বাংলাতে লেখার দরকার নেই, তাহলে ইংরেজিতেই লিখুন। ওইকটা ক্রিয়াপদ বা অব্যয়-টব্যয় যা আছে সেগুলো লোকে ইংরেজিতেই পড়ুক। কিন্তু সেইটা হলে যে মুশকিল হয়, এখন আপনি হয়তো বললেন, ঠিক আছে ইংরেজিতেই পড়ুক, তাতেই বা অসুবিধা কী? এখন ‘আপনি’ মানে এখানে ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে বলছি না সেটা আপনি জানেন, তাহলে অসুবিধাটা কী?
অসুবিধাটা হচ্ছে এই যে, সমস্ত কিছু অন্য ভাষায় পড়লে যে মুশকিলটা হয় আমাদের চিন্তা তো সবসময় সেই অন্য ভাষায় হয় না, আমাদের চিন্তা— আমাদের কল্পনা— আমাদের যে আশা-আকাঙ্ক্ষা এগুলো ধরুন আমার বা আপনার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষায় হয়। কাজেই তার সঙ্গে এই বিষয়টার সংযোগ হয় না। সেগুলো মস্তিষ্কে আলাদা একটা প্রকোষ্ঠে জমা হয়ে থাকে। মুশকিলটা হচ্ছে যে বিজ্ঞানের গবেষণায় একটা খুব বড় ব্যাপার হচ্ছে কল্পনা। মানে এমন তো আর নয় যে কেউ খাতার ওপরে এবিসিডি-ইন্টিগ্রাল-সাইন-কজ-শুঁড়ের মতো ইকুয়াল টু ইত্যাদি লিখতে শুরু করল, তার পর দেখা গেল হঠাৎ করে তার থেকে একটা … কাজেই একটা কিছু পেতে পারি, সেই কল্পনাটা তো হচ্ছে গিয়ে আমাদের নিজেদের ভাষায়। পুরো জিনিসটা অন্য ভাষায় পড়ে সেই কল্পনাটাকে নিজের ভাষায় এনে আবার অন্য ভাষায় সেটাকে রূপান্তর করতে পারি, তাহলে মনের যে কসরতটা খরচ হয়, সেইটার জন্য একটা কিছু ফাঁক থেকে যায়। ধরুন আমার মতো অনেক বাঙালি বিজ্ঞানীর ক্ষেত্রেই যেটা হয়, আমরা অনেক যে গবেষণা করি সেটার মধ্যে একেবারেই নতুন ধারণা খুব কম থাকে। মানে অন্য একজনে একটা মডেল হয়তো দিয়েছেন, আমরা সেটার ওপর কথা বলে (বা কাজ করে) সেই মডেলটা কোথায় প্রযোজ্য হতে পারে, কোথায় তার অসুবিধা হতে পারে, এই সমস্ত আলোচনা করতে খুব ভালো পারি। কিন্তু নিজের থেকে একটা মডেল দেওয়া, এইটা আমরা পারি না। তার কারণ হচ্ছে ওই, আমাদের কল্পনার সঙ্গে বিজ্ঞানের যে ব্যাপারটা, সেটার মধ্যে একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। যার জন্য সেইখানে যেতে হবে, যাওয়াটা উচিত, যাওয়াটা বাঞ্ছনীয়। আবার পুরোপুরি যাওয়াটা, মানে কতটা যাব না যাব, মানে শেষকালে তো গবেষণাপত্র লিখতে হলে সেটা তো সেই ইংরেজিতেই লিখতে হবে। সেটা আমি বাংলায় লিখে বলে দিলাম যে হ্যাঁ আমি করেছি, মানে পৃথিবীতে বাঙালি ছাড়া আর কেউ জানল না, সেটা হলে তো কোনও লাভ নেই। কাজেই সেখানে আবার কোনও একটা সেতু বন্ধন করতেও হবে। এটা খুব সহজ কাজ তা নয়, আবার এটা যে খুব শক্ত কাজ তা-ও নয়, কেন না না, ইংরেজি ছাড়াও বহু ভাষা আছে পৃথিবীতে, [সেই ভাষাভাষী মানুষদের] অনেকেই খুব ভালো কাজ করছেন, এবং সফলভাবেই করছেন; কাজেই মানসিক প্রতিবন্ধকতা ছাড়া আমাদের না পারবার কোনও কারণ নেই।
ডাঃ চৌধুরী:এই মানসিক প্রতিবন্ধকতা কথাটা আমার ভীষণ ভালো লাগল, আমি সেই প্রশ্নটাই আপনাকে করতে যাচ্ছিলাম, আপনার এই আলোচনার ঢেউ থেকে, বহু বিজ্ঞানী বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে যখন বলেছি যে আমাদের বাংলা ভাষায় লেখকের সংখ্যা বাঙালি বিজ্ঞানীদের তুলনায় অনেক কম, তো সেই জায়গা থেকে তুমি কী করতে পারো… তো তিনি বলেছেন যে আমি ইংরেজিতেই লিখে দেব। তো আপনার কী মনে হয়, এটা বহুদিন ধরে চর্চা না করা বা চর্চার জায়গায় সমস্যা, তো আপনার কী মনে হয়?
অধ্যাপক পাল: দেখুন একটা কথা মনে রাখতে হবে, যে যতজন লোকে বিজ্ঞানের গবেষণা করবেন, তার সবাই জনসাধারণের জন্য বিজ্ঞান পরিবেশন করবেন এটা তো আশা করা যায় না। এটা কোনও ভাষাতেই হয় না, ইংরেজিতেও হয় না। যত বিজ্ঞানী রয়েছেন, তার যদি শতকরা দশ ভাগ জনসাধারণের জন্য কিছু লিখতে রাজি হন তাহলেই কাজ চলে যায়। কিন্তু বাংলার ক্ষেত্রে হয়তো সেইটাতে হবে না, শতকরা পাঁচ ভাগ দিলে হবে না। বা আসলে দেখা যাবে যে শতকরা পাঁচ ভাগ লোকেও উৎসাহী নন। সকলেই যে উৎসাহী হবেন এটা মনে করবার কোনও কারণ নেই। সকলের সবদিকে উৎসাহ থাকে না। এখন যিনি বিজ্ঞানের গবেষণা করছেন তাঁকে জন সাধারণের জন্য সেটাকে প্রকাশ করবার জন্য উৎসাহী হতেই হবে, এ কথা মনে করবার কোনও কারণ নেই। বড় বড় বিজ্ঞানীদের কথাই যদি ভাবি, পদার্থবিজ্ঞানীর কথাই যদি আমি ভাবী, ধরুন আইনস্টাইন নিজে খুব উৎসাহী ছিলেন জনসাধারণের জন্য লেখার [ব্যাপারে], তিনি ১৯১৫ সালে আপেক্ষিকতার ব্যাপক তত্ত্ব প্রবর্তন করার পরে ১৯১৬ সালে একটা সর্বজনবোধ্য বই লেখার চেষ্টা করেছিলেন। আবার অন্যদিকে তাঁর সমগোত্রের একজন বিজ্ঞানী পল ডিরাক, তিনি কোনও দিন সাধারণের জন্য লেখার চেষ্টা করেননি, তিনি মনে করেছিলেন যে ওটা তাঁর এক্তিয়ারের মধ্যে নয়। তাঁকে একবার কোনও এক সংবাদপত্রের একজন ইন্টারভিউতে প্রশ্ন করেছিলেন যে আপনার কি আপনার এই যে ইলেকট্রন সম্বন্ধে তত্ত্ব সেটা আমাদের পাঠকদের জন্য একটু সহজ ভাষায় বলতে পারেন? তাতে তাঁর উত্তর ছিল, না পারি না। এখন তিনি পারেন না, চাননি, তাঁর এ বিষয়ে উৎসাহ নেই। কাজেই কিছু কিছু লোকের উৎসাহ থাকবে না এটাও কিন্তু ধরে নিতে হবে। সকলকেই তার জন্য কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে এর কোনও মানে হয় না। যাঁর উৎসাহ আছে তাঁকে দিয়ে লেখাতে হবে; যাঁর নেই, ঠিক আছে। সবাই তো কবিতা পড়ে না, সবাই তো কবিতা লেখে না, কাজেই সবাই বিজ্ঞান লিখবে এটা মনে করবার কোনও কারণ নেই।(চলবে)