সাক্ষাৎকার/২

সাক্ষাৎকার/২

বিজ্ঞানভাষ সংবাদদাতা
Posted on ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১

বিজ্ঞান-সাংবাদিকতা বনাম বিজ্ঞান-সাহিত্য

(বিশিষ্ট পদার্থবিদ ও বিজ্ঞানলেখক, এবং ভাষাতাত্ত্বিক অধ্যাপক পলাশ বরন পালের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন চিকিৎসক ও বিজ্ঞানভাষ-এর প্রধান সম্পাদক ডাঃ অভিজিৎ চৌধুরী)

ডাঃ চৌধুরী: একদম, একদম ঠিক। যাঁরা পাঠক-শ্রোতা, তাঁদেরকে বলতে চাই যে আমরা এমন একজনের সঙ্গে কথা বলছি তিনি পদার্থবিজ্ঞানী, পাশাপাশি তিনি কবি, আবার বিজ্ঞানের দর্শন নিয়েও লেখালিখি করেন; তো আমার মনে হয় বিজ্ঞানে তো প্রবল ধীশক্তি লাগে, বোধ শক্তি অবশ্যই লাগে, আর কবি সাহিত্যিকদের আবেগকে ঘন হতে হয়। তো আমার মনে হয় সাহিত্য আর বিজ্ঞানের সম্মিলন ঘটাতে গেলে, অথবা লেখক হতে গেলে এই তিনটে জিনিসের সম্মেলন না ঘটলে তিনি লেখক হতে পারবেন না বা বিজ্ঞান চর্চা করতে পারবেন না, এটা কি সত্যি? আমার কেন মনে হল, আপনি দুটি উদাহরণ বললেন, আবার উলটো দিকে দাঁড়িয়ে সত্যেন্দ্রনাথ বসুও তো বাংলায় বিজ্ঞানচর্চা করেছেন, তো কীভাবে ধীশক্তি আর আবেগ, অর্থাৎ কগনিশন আর ইমোশন, এই দুটোকে যদি পাশাপাশি রাখি, এই দুটোর ব্যালেন্স করে কীভাবে একজন বিজ্ঞান-লেখক হতে পারেন, এই ব্যাপারে আপনার নিজের অন্তর্দৃষ্টি থেকে যদি একটু বলেন।

অধ্যাপক পাল: দেখুন, কয়েকটা বিষয় বিজ্ঞান-গবেষণা করতে গেলে লাগে, অর্থাৎ সংবাদপত্রে পরিবেশন করবার কথা আমি বলছি না, বিজ্ঞানের গবেষণা করতে গেলেও যেমন লাগে, কবিতা লিখতে গেলেও তেমনিই— তার মধ্যে একটা বড় বিষয় হচ্ছে কল্পনা, যেটার কথা আমি আগেই বলেছিলাম। কল্পনা না থাকলে বিজ্ঞান হয় না, কল্পনা না থাকলে কবিতাও হয় না। আমি তো আমার ছাত্রদের বলি ভালো করে কবিতা পড়ো। মানে কবিতা পড়লে মন যেভাবে প্রস্তুত হয়, বিজ্ঞান [গবেষণা] করবার জন্য অন্য কোনোভাবে সেটা সম্ভব নয়। সাহিত্যও কিন্তু নয়, শুধু কবিতা, মানে উপন্যাসেও এই জিনিসটা হয় না, সেখানে কল্পনা না-ও থাকতে পারে। কীরকম উপন্যাস তার ওপর নির্ভর করে। কিন্তু কবিতার মধ্যে একটা কল্পনার অংশ থাকে, এবং আবেগের অংশটা না থাকলে তো কোনও সৃষ্টিশীল কাজই করা যায় না। সেটা শুধু বিজ্ঞান বা সাহিত্য রচনা কেন, যিনি গান করছেন, তাঁরও তো সেই আবেগ বা সেই দরদ— সেটা তো থাকতে হবে। কাজেই কতগুলো দিক থেকে মিল আছে, আবার কতগুলো দিক থেকে অমিলও আছে। যখন আমরা সাহিত্য পড়ি, তখন সমস্ত কথা একেবারে কাঁটায় কাঁটায় একটা জায়গায় গিয়ে পরিষ্কার ভাবে বুঝতে হবে, এমনটা প্রত্যাশা করি না। বরং অনেক জায়গায় ব্যাপারটা একটু ঝাপসা রেখে দেওয়াই হয়তো সাহিত্য। আমি একটা উদাহরণ দিই— রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গান [গেয়ে উঠলেন] প্রাঙ্গনে মোর শিরীষশাখায় ফাগুন মাসের কী উচ্ছ্বাসে ক্লান্তিবিহীন ক্লান্তিবিহীন ফুল ফোটানোর খেলা, ক্ষান্ত কূজন শান্ত বিজন সন্ধ্যাবেলা। প্রত্যহ সেই ফুল্লশিরীষ প্রশ্ন সুধায় আমায় দেখি, এসেছে সে কী এসেছে সে কী… তাই তো? এর মধ্যে কোথাও একটাও শক্ত শব্দ নেই, ক্ষান্ত কূজন শান্ত বিজন, একটু ভাবলেই বোঝা যাচ্ছে, মানে এমন কিছু শক্ত শব্দ নয়। কিন্তু তার মানেই যে সব পরিষ্কার করে বলা হয়েছে তাও কিন্তু নয়। এই যে শেষ কালে যে প্রশ্ন, ‘এসেছে কী, এসেছে কী’— পরবর্তী স্তবকগুলোতেও ‘আসেনি কি’ বা ‘সে কি এল’ এইভাবেই সব প্রশ্ন করা হচ্ছে। কার আসার কথা হচ্ছে, এটা কিন্তু কবিতার কোথাও বলা নেই। এবং বলা যে নেই এটাই কিন্তু কবিতার একটা বিশাল জোর। এইখানেই আপনার কল্পনাকে, আপনি-আমি বা পাঠকের ওপর রবীন্দ্রনাথ ছেড়ে দিচ্ছেন। তুমি ভেবে নাও কার আসার কথা হচ্ছে, আমি বলে দেব না। এখন এই যে খানিকটা কুহেলিকা রেখে দেওয়া, এটাও সাহিত্যের ধর্ম। কিন্তু এইখানেই বিজ্ঞানের সঙ্গে তফাৎ। বিজ্ঞানে এইটা করলে চলবে না। বিজ্ঞানে আমাকে সমস্ত কথা পরিষ্কার করে বলতে হবে। সমস্ত কথা মানে যে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত কিছু আমি জেনে ফেলেছি সেটা তো নয়, কিন্তু আমি যে বিষয়ে কথাতা বলছি, সেই বিষয়ে কোনও ধোঁয়াশা রাখলে চলবে না। আমি যে পরিভাষাটা ব্যবহার করছি, তার অর্থ কী, তার একেবারে সঠিক কী বলছি, কী বলছি না, কী ফাঁদে পাঠক পড়তে পারেন যেটা আমার উদ্দিষ্ট নয়, পরিষ্কার করে কথাটা বলতে হবে।
যেটা বললাম, সাদৃশ্য আছে দুটো বিষয়ে, পার্থক্যও আছে। এখন সেগুলো বিষয়ের ধর্ম, সেভাবেই এগোতে হবে। দুটো বিষয় এক কেউ তো বলছে না, কাজেই যে বিষয়ের যেরকম ধর্ম, সেভাবেই চলতে হবে। এখন লেখার সময়েও সেই কথা মনে রাখতে হবে।

ডাঃ চৌধুরী: এই প্রসঙ্গের খেই ধরেই আপনাকে প্রশ্ন করি, বিজ্ঞানের সংবাদ পরিবেশন, বিজ্ঞানের নিবন্ধ লেখা আর বিজ্ঞান-সাহিত্য, এই যে নানান শব্দগুলো আমরা রাখি ডিফারেনশিয়েট করার জন্য এই তথ্য বা তত্ত্বের পরিবেশনা করা হয়, এগুলোকে আপনি কী চোখে দেখেন? মানে বিজ্ঞান-সংবাদ পরিবেশনায় ভীষণ সরল হতে হবে আর বিজ্ঞান-সাহিত্য পরিবেশনের সময় সেটাকে সাহিত্যের দিকে টিল্টেড হতে হবে, এরকম কি কোনও সীমারেখা টানা আছে, নাকি নেই?

অধ্যাপক পাল: বিজ্ঞান-সংবাদ পরিবেশনা এবং বিজ্ঞান-সাহিত্য এই দুটোর মধ্যে পার্থক্য বলতে চাইছেন, তাই তো? এখন দেখুন, সংবাদ যখন আমি পরিবেশন করছি তখন সেই মুহূর্তে বড় খবর কোনটা সেইটা বোঝাচ্ছি। কিন্তু আমি বিজ্ঞান সম্বন্ধে যখন আমি একটা বড় নিবন্ধ রচনা করছি, তখন তো আর সবসময় ঠিক গত তিন মাসে কী ঘটেছে সেটা বলছি না, বরং অনেক সময় একটা ইতিহাস টেনে, এই গত দু হাজার বছরে কী হয়েছে সেরকম কথা বলার চেষ্টা করছি। কাজেই পরিধি সেটার অন্যরকম। এটা হচ্ছে প্রথম ব্যাপার। এখন পরিধির জন্য বিষয়বস্তুর উপস্থাপনারও তফাৎ হয়। প্রথম যেটা তফাৎ, সেটা হচ্ছে সংবাদ পরিবেশনার ক্ষেত্রে … প্রতিবেদন আপনি যদি তিন হাজার শব্দের লেখেন, সংবাদ থাকবে না। আবার তেমনই নিবন্ধ রচনার সময় আপনি যদি আড়াইশো শব্দে নিবন্ধ দিয়ে ছেড়ে দেন, তাহলে লোকে বলবে যে আপনি ফাঁকি মেরেছেন। এখন এইটা তো একটা বড় তফাৎ, মানে কতখানি আমি দেব। এখন সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে আমার একটা কথা মনে হয়, সেটা হচ্ছে যে এইখানে একটা খুব জটিল প্রশ্ন আছে। যে জটিল প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না। মানে আমি যদি জানতামও আমার উত্তর অন্যদের সঙ্গে মিলত, এরকম কোনও প্রত্যাশা আমার নেই। সেটা হচ্ছে এই, যে ঠিক কোনটা সংবাদ হিসেবে পরিবেশন করা হবে। কেননা অনেক সময় বিজ্ঞানের গবেষণায় আমরা এমন বিষয় নিয়ে কথা বলি, যেগুলো সেই মুহূর্তে বিজ্ঞানীমহলেই যে সবাই সেটাকে গ্রহণ করেছেন এমন অবস্থা নয়। সেটা আস্তে আস্তে গৃহীত হয়, বা বর্জিত হয়। কোনও একটা জিনিস কেউ একটা বললেন, সেটা দু-তিন বছর গবেষণার পরে দেখা গেল না এটা দিয়ে হবে না। এখন এই যে দু-তিন বছর পরে দেখা গেল এটা দিয়ে হবে না, এই দু-তিন বছরে কে কী বললেন কে কী করলেন এর কী পুঙ্খানুপুঙ্খ সংবাদ দেওয়াটা প্রয়োজন, নাকি প্রয়োজন নয়? বিজ্ঞানে সেটা গৃহীত হলে তবেই সেটা পরিবেশনার যোগ্য সংবাদ হিসেবে বিবেচিত হবে? অনেক ক্ষেত্রে এমন হয় যে সত্যি সত্যি গৃহীত হওয়ার আগে বিজ্ঞানীমহলেও সেটা সংবাদ হয় না। এর একটা বিরাট বড় উদাহরণ হচ্ছে এই কয়েক সপ্তাহ আগেই মারা গেলেন বিজ্ঞানী স্টিভেন ওয়াইনবার্গ, ইনি এবং আবদুস সালাম একটি তত্ত্ব উপস্থাপনা করেন, যেটা ওই লঘু বলের তত্ত্ব। লঘু বল হচ্ছে পদার্থে পদার্থে যে নানান রকম ক্রিয়া বিক্রিয়া হয় সেটা মূলত চার রকম বলের প্রভাবে হয়, তার মধ্যে একটা হচ্ছে লঘু বল, আপাতত এইটুকু বললেই চলবে। তা সেই লঘু বলের একটি তত্ত্ব দিয়েছিলেন ১৯৬৭ সালে। কিন্তু ১৯৬৭ সালে যখন তাঁরা দিয়েছিলেন তখন সেটাকে কেউ পাত্তা দেয় নি। কেউ মানে হচ্ছে, এখানে পাত্তা দেওয়ার একটা নির্দেশক বা সূচক হচ্ছে অন্যরা ওইটার ওপর ভিত্তি করে কতগুলো গবেষণা করলেন; কতগুলো গবেষণাপত্রে ওই জিনিসটা উল্লিখিত হল। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এই যে ওয়াইনবার্গ এবং সালামের কাজ, তা উল্লিখিত হয়েছিল যতদূর জানি একটি মাত্র গবেষণাপত্রে। কিন্তু ১৯৭১-এ তাঁদের এই তত্ত্ব সম্পর্কে একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আবিষ্কার করলেন জেরার্ড ঢুফট (Gerard’t Hooft) নামে একজন বিজ্ঞানী। তখন বিজ্ঞানী মহলে টনক নড়ল, যে এই রে! তাহলে তো চার বছর আগে যেটা হয়েছিল সেটা তো একটা দারুণ জিনিস! সুতরাং দেখুন এটা কিন্তু ওয়াইনবার্গ এবং সালামের এই যে তত্ত্ব, এটা কিন্তু বিজ্ঞানীমহলেও প্রকাশের চার বছর পরে খবর হয়েছে। কাজেই বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এরকম একটা সময়ের ব্যবধান থাকে, একটা জিনিস প্রস্তাবিত হওয়া এবং সেই জিনিসটা গৃহীত হওয়া— এই দুটোর মধ্যে একটা ব্যবধান থাকে। আমার নিজের মত, আমি আগেও বলেছি, তাও আবার বলছি যে আমার মতের সঙ্গে সবাই একমত হবেন এরকম প্রত্যাশা আমি করি না, কিন্তু আমার মতটা বলবার আমার অধিকার আছে, এইটুকু প্রত্যাশা আমি করি। সেটা হচ্ছে এই, বিজ্ঞানীমহলে ব্যাপারটা খানিকটা অন্তত গৃহীত হওয়ার পরে [তবে] সেটা সংবাদমাধ্যমে আসা উচিত। কিন্তু সংবাদ পরিবেশকরা কেন, এখন অনেক বিজ্ঞানীরাও আর এই মতে সায় দেন না। তাঁরা প্রথমেই একটি প্রেস কনফারেন্স করে তাঁদের ফলাফল ঘোষণা করেন। এখন সে ক্ষেত্রে তো তাঁরা চাইছেন যে সেটা সংবাদ হোক, কাজেই সেক্ষেত্রে তো আমার কিছু বলবার নেই। (চলবে)