ভালোবাসা শুধু দোলায় আর ভাসায়। তার কোন কুল নেই আছে শুধু আকুল পাথার। এই বলেই আমরা জেনে এসেছি। এহেন যে প্রেমের রূপ তাকে যদি জৈবিক ধারাপাত দিয়ে বাঁধার চেষ্টা করা হয় তাহলে আলোড়ন উঠতেই পারে। অনেকের বুকেই ব্যথা লাগবে এটা জানতে পারলে যে কবি চন্ডীদাসের মস্তিষ্কে ভেসোপ্রেসিন বেশি ছিল আর রামি ধোপানির ছিল অক্সিটোসিনের আধিক্য। এও ভাবা যেতে পারে যে, অমিত রায়ের ভেসোপ্রেসিন জিনের “গেইন অফ ফাংশান মিউটেশন” ছিল, তাই তিনি অতি সহজে লাবণ্যের প্রেম ডিঙ্গিয়ে কেতীর কন্ঠলগ্ন হতে পেরেছিলেন। এরই পাশাপাশি লাবণ্যের ছিল পরিমিতি সঞ্চারী অক্সিটোসিন, যা প্রেমকে দিগন্তে নিয়ে যায় আবার অতলের আহ্বানে বেঁধে রাখে। বিজ্ঞানীরা তাদের ভাষায় খুঁজে পাচ্ছেন যে পাগলপারা ভালবাসা বা উথলে ওঠা প্রেম আদতে মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে কিছু হরমোনের অগোছালো নড়াচড়ার ফসল। এক কথায় ছেলেদের ভেসোপ্রেসিন আর মেয়েদের অক্সিটোসিন এই দুই হরমোনের অনাবিল পথচলার ফলেই ভালোবাসা গভীরতা পায়, কখনও বা তা পথভ্রূষ্ট হয়। এদেরই নানা জৈবিক প্রকরণের হেরফেরে প্রেম কখনও বা গাছে গাছে নেচে বেড়ানো ফিঙে পাখীর আচরণের রূপ নেয়, কখনও বা সারাদিন গেয়ে চলে “তুহু মম মন প্রান হে!”।
ভালোবাসা কিংবা কাব্যেরও জৈবিক ভিত্তি থাকতে পারে, এটা ভাবতে সত্যিই মন চায় না। এর অর্থ অংক কষে মন মাপার চেষ্টা করা, ঘটি দিয়ে যেমন জল মাপা যায়। আক্ষরিক অর্থেই অসম্ভব তা। অথচ বিজ্ঞানীরা সবসময়ই বেড়া টপকাতে চান, যেমনটা চায় প্রেম। দেওয়াল টপকাতে না পারলে ভালোবাসা যেমন জমে না, অজানার প্রান্তরে বাঁশি না বাজালে এবং নতুন সুর না তুলতে পারলে বিজ্ঞানও যেন কেমন ম্যাড়মেড়ে, উদ্দীপনাবিহীন এবং অনুত্তেজক হয়ে থাকে। রোহিনী কেন মাঝরাতে গোবিন্দলালের কাছে ছুটে যেত? ডেসডেমোনাকে ছাড়া ওথেলো তার নিজের জীবনটাকে ভাবতে পারতনা কেন? এইসব নিতান্তই অজৈবিক বিষয় নিয়ে সারাজীবন গবেষণা করেছেন বিজ্ঞানী ল্যারি ইউং। তিনি এই রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য “প্রাইরী ভোল” নামের গিনিপিগের মতো দেখতে প্রাণী নিয়ে। জীবজগতে বহুগামীতার সাধারণভাবে প্রচলন থাকলেও এই প্রাণীটি প্রজাতিগত ভাবে তা এড়িয়ে চলে। এক পুরুষ এবং এক নারী এই নিয়েই তারা জীবন কাটায়। ইউং তাই দেখে নিয়েছিলেন এই প্রাণীটির স্নায়ু রাসায়নিক বিন্যাশ তলিয়ে দেখার কাজ, যাতে করে মানুষের কাছাকাছি পৌছনো যায়। ছেলেদের ভেসোপ্রেসিন এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে অক্সিটোসিন এই দুই স্নায়ু-রাসায়নিকের নানা যোগ-বিয়োগ, বাঁকা-ট্যারা মিলন ও বিচ্ছেদের ছন্দেই তৈরি হয় ভালোবাসা এবং যৌন আকর্ষণের ভিত্তি। ইউং স্বপ্ন দেখতেন কিন্তু চিন্তিত হতেন এইভেবে যে প্রেম যদি সত্যি সত্যিই জৈবিক হয় তাহলে তা অচিরেই গিয়ে পড়বে ওষুধ ব্যবসায়ীদের হাতে। তৈরি হবে ভালোবাসা সঞ্চারী ওষুধ। ভালোবাসাই পৃথিবীতে একমাত্র শাশ্বত সত্য হয়ে ঘোরাফেরা করবে। চারপাশ ভরে যাবে ভালোবাসার উদ্যানে যেখানে কিলবিল করবে আদম আর ইভেরা। নাওয়া-খাওয়া ভুলে হৃদয়ের প্লাবনে ভাসবে রাজপথ, জনপথ। ইউং-এর গবেষণায় এসেছিলো ভালোবাসায় পবিত্রতার, একমুখীনতার ভিত্তির ব্যাখ্যাও। যারা উচ্চকণ্ঠে বলেন “মানুষ মূলগতভাবে বহুগামী”, তাদের স্নায়ু-রাসায়নিক ভিত্তিও ইউং দেখিয়েছেন তার গবেষণায়।
বহুমাত্রিক পৃথিবীতে প্রেমের শাশ্বত এবং একদেশদর্শী রামি-চণ্ডীদাস রূপের পাশাপাশি চলতি “ইটস নট ফেয়ার টু ক্যারী এ রিলেশন অন ফর মোর দ্যান কাপল অফ মান্থস অ্যান্ড মে বি ফর সাম ইয়ার্স”। এই ভাবনার জৈবিক ভিত্তি কি তা নিয়েও জীবন কাটিয়েছেন প্রফেসার ইউং। লোকে তাকে ‘প্রেমের ডাক্তার’ বলে ডাকত। ভালোবাসার ওষুধ আসলে যুদ্ধ, হানাহানি কমে যাবে পৃথিবীতে- ইউং বলতেন। ইমোরী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ল্যারী ইউং সম্প্রতি চলে গেলেন সেই হৃদয়ের অসুখেই।