সাম্প্রতিককালে সিকিমে হিমবাহ-হ্রদ ফেটে পড়ার ফলে বিধ্বংসী প্লাবন বহু মানুষের ক্ষতি করেছে, চুংথাং বাঁধ ধ্বংস করেছে। এই বাঁধ তিস্তার তিনটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, এবং নদীর তীরবর্তী বেশ কয়েকটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পকে অকার্যকর করে দিয়েছে। গ্লেসিয়ার লেক আউটবার্স্ট ফ্লাড (GLOF) অর্থাৎ হিমবাহের গলন থেকে তৈরি হওয়া বড়ো হ্রদের জল হঠাৎ করে তাদের মোরাইন থেকে মুক্ত হয়ে যায়। মোরাইন হল একধরনের প্রাকৃতিক বাঁধ যা পাথর, পলি এবং অন্যান্য ধ্বংসাবশেষ থেকে তৈরি হয়। উত্তর সিকিমে অবস্থিত দক্ষিণ লোনাক হিমবাহটি দ্রুততম পশ্চাদপসরণকারী হিমবাহগুলোর মধ্যে একটি। ১৯৬২ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত এই ৪৬ বছরে হিমবাহটি প্রায় ২ কিমি পিছিয়েছে এবং ২০০৮ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত প্রায় ৪০০ মিটার পিছিয়ে গেছে।
ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অরগানাইজেশনের ন্যাশনাল রিমোট সেন্সিং সেন্টারের তোলা স্যাটেলাইট চিত্র থেকে জানা যায় যে হিমবাহ-পুষ্ট হ্রদের প্রায় ১০৫ হেক্টর জল নিষ্কাশন হয়েছে৷ সেপ্টেম্বর মাসে হ্রদটি ১৬৭ হেক্টর বিস্তৃত ছিল এবং ৪ অক্টোবর, দুর্যোগের রাতে, হ্রদটি ৬২ হেক্টরে সঙ্কুচিত হয়েছিল। ডিএসটি-ওয়াদিয়া ইনস্টিটিউট অফ হিমালয়ান জিওলজির ডিরেক্টর কালাচাঁদ সাইনের মতে যেহেতু স্যাটেলাইট চিত্র হ্রদের গভীরতা প্রকাশ করতে সক্ষম নয়, তাই স্থানটি শারীরিকভাবে পরিদর্শন না করেই হ্রদের জলের পরিমাপ করা বেশ চ্যালেঞ্জিং৷ সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশন (সিডব্লিউসি) দ্বারা রক্ষণাবেক্ষণ করা জল-পর্যবেক্ষণ যন্ত্র অনুসারে সাংকালাং-এ দুপুর ১.৩০ টায় জলের স্তরের উচ্চতা প্রায় ৬০ ফুট ছিল এবং প্রায় ৫৫ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা বেগে প্রবাহিত হয়েছিল। ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি রিপোর্ট অনুযায়ী হঠাৎ ঢেউয়ের প্রাথমিক কারণ অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত এবং গ্লেসিয়ার লেক আউটবার্স্ট ফ্লাড বলে মনে করা হচ্ছে। হ্রদটি ৫২০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এবং হ্রদের উত্তরে প্রায় ৬৮০০ মিটারে একটি বিশাল বরফের চাঁই রয়েছে। অনুমান করা হচ্ছে যে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে মোরাইন ভেঙে যেতে পারে এবং বন্যার সূত্রপাত হতে পারে কিন্তু আবহাওয়া সংক্রান্ত রেকর্ড এই ধরনের ভারী বৃষ্টির কোনো প্রমাণ প্রকাশ করে না। নেপালে ৩রা অক্টোবর বিকেলে পরপর কয়েকটি কম্পন অনুভূত হয় যার ভূমিকা থাকতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন। লোনাক হ্রদের দূরত্ব এই স্থান থেকে প্রায় ৭০০ কিমি এবং তাই মনে করা হচ্ছে এই ভূমিকম্পনও এর কারণ হতে পারে।
গবেষকদের মতে এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃতি এবং তীব্রতা উভয়ই ভবিষ্যতে দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। মানুষের হস্তক্ষেপের ফলে হিমালয়ের বাস্তুতন্ত্র খুব সহজেই বিঘ্নিত হচ্ছে এবং সেই অঞ্চলের মানুষেরা এর ফলে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা একটি আর্দ্র ভবিষ্যতের দিকে আমাদের নিয়ে যাচ্ছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চরম ঘটনা ঘটছে। জলবিদ্যুৎ এবং অন্যান্য বাঁধ নির্মাণের ফলে হিমালয়ের বাস্তুতন্ত্র বিঘ্নিত হচ্ছে। GLOF এই অঞ্চলের উষ্ণায়নের একটি প্রভাব এবং এটি এই অঞ্চলের জন্য বড়ো ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিকিমে তিস্তা নদী বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের উৎস। বাঁধ নির্মাণ এবং অন্যান্য প্রকল্পের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আরও যত্নের প্রয়োজন। ডঃ সাইনি বলেন যে প্রারম্ভিক সতর্কীকরণ ব্যবস্থা বাস্তবায়িত করা গেলেও একটি সমন্বিত পদ্ধতির প্রয়োজন যাতে একাধিক সংস্থা অবিলম্বে স্যাটেলাইট ছবি শেয়ার করতে পারে এবং পর্যাপ্ত সতর্কতা প্রদানের জন্য সেন্সরগুলোর নেটওয়ার্ক কার্যকারিতাও গুরুত্বপূর্ণ। ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে যেমন আকস্মিকতা অনেক বেশি কিন্তু GLOF-এর ক্ষেত্রে যেহেতু আমরা হ্রদের আকারের পরিবর্তনগুলো পর্যবেক্ষণ করতে পারি তাই আগে থেকে অনুমান করা যেতে পারে তবে এর জন্য আরও বেশি সমন্বয় প্রয়োজন।