তৃতীয় কিস্তি
[*ভাষার বৈচিত্র্যের ও জীববৈচিত্র্যের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্দ। কোনো জনজাতি বিপন্ন বা অবলুপ্ত হয়ে গেলে যেমন জীববৈচিত্র্যের ওপর সরাসরি প্রভাব পড়ে, তেমনই কোনো প্রজাতি বিপন্ন হলে মানুষের জীবনেও তার প্রভাব পড়ে।]
অন্যদিকে, ভারতবর্ষকে যদি জীববৈচিত্র্য অঞ্চল হিসেবে দেখা হয় তাহলে ভারতকে ১০-টা জৈবভৌগোলিক অঞ্চলে ভাগ করা হয়। তারমধ্যে সমুদ্র-প্রভাবিত অঞ্চলও রয়েছে। ট্রান্স হিমালয়, হিমালয়, মরুভূমি, প্রায়-শুখা, পশ্চিমঘাট পর্বতমালা, ডেকান পেনিসুলা, গাঙ্গেয় সমতল, সমুদ্রতীর, উত্তর-পূর্ব এবং দ্বীপ। অর্থাৎ, জৈবভৌগোলিক অঞ্চল আর রাজ্য একজিনিস নয়। অন্যদিকে রাজ্যস্তরে জীববৈচিত্র্যের তথ্য আমি হাতে পাই নি, যে-কারণে রাজ্য-প্রতি প্রজাতির বিভিন্নতার উচ্চহার বা জৈব-বণ্যতার তথ্যও পাই নি। কিন্তু একথা সকলেই স্বীকার করেন অরণ্য বা বনানীই হচ্ছে উচ্চ জৈববৈচিত্র্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এবং প্রতি রাজ্যেই অরণ্য আচ্ছাদিত জমির পরিমান রাজ্যের মোট জমির তুলনায় অতি নগন্য যেমনভাবে আমরা দেখেছি রাজ্যের মূল ভাষা ছাড়া অন্যান্য ভাষার ভাষীর সংখ্যাও নগন্য। সেই কারণেই অরণ্য-আচ্ছাদিত অঞ্চলকেই জৈববৈচিত্র্যের আকরভূমি হিসেবে এই কাজে ধরা হয়েছে।
মোট জনসংখ্যার ভিত্তিতে অন্যান্য ভাষীর রাজ্যভিত্তিক জনসংখ্যা এবং রাজ্যের মোট আয়তনের নিরিখে অরণ্য-আচ্ছাদিত অঞ্চলের তথ্যের তুলনামূলক দৃশ্য ও তাদের মধ্যেকার সম্বন্ধের চিত্রায়িত চেহারা দেখতে চিত্র ১ দেখুন।
চিত্র ১
ছবিটার দিকে তাকালেই বোঝা যাবে উত্তর-পূর্ব ভারতে একদিকে যেমন জীববৈচিত্র্যের হার বা অরণ্য-আচ্ছাদনের হার খুব বেশি অন্যদিকে তেমনই সেখানকার ভাষারও বৈচিত্র্য অনেক। বিশেষ করে অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মেঘালয়, ইত্যাদি রাজ্যে অসংখ্য নৃগোষ্ঠী তাঁদের অসংখ্য ভাষা, এবং সেগুলোর অসংখ্য। অন্যদিকে ২০১১-র আদমসুমারী অনুযায়ী এই রাজ্যগুলোয় প্রধান ভাষা অর্থাৎ সরকারী স্বীকৃত ভাষা ব্যতিত “অন্যান্য” ভাষার জনসংখ্যা ওই ওই রাজ্যের মোট জনসংখ্যার যথাক্রমে; ৭২.১৩%, ৮৮.১৩%, ৮৭.৬৫%, এবং ৮৫.৩৫%। আবার ওই রাজ্যের অরণ্য-আচ্ছাদিত অঞ্চল মোট আয়তনের যথাক্রমে; ৮০.৩০%, ৭৮.২১%, ৮৮.৯৩% এবং ৭৬.৭৬%। আমার মতে সিকিম এবং আন্দামান নিকোবরের অঞ্চলগুলোয় সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে এই বৈচিত্র্যের হার অপেক্ষাকৃত কম। তবে রাজস্থান, ঝাড়খণ্ড এবং মহারাষ্ট্রে অনেক আদিবাসী কৌম ও বনানী রয়েছে। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা এবং তামিলনাড়ু উন্নয়নশীল রাজ্য হতে গিয়ে তার ভাষা ও জৈববৈচিত্র্য অনেকাংশেই হারিয়েছে। গুজরাটের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটবে হয়ত। ১-নম্বর ছবিতে ভাষা ও জৈববৈচিত্র্যের একটা তুলনামূলক তথ্যের আভাস পাওয়া যাবে।
টেবিল ১-এর তথ্য অনুযায়ী আমি ওপরে বলা দুই চল বা চলরাশির মধ্যে সম্বন্ধ দেখতে পেয়েছি, যেখানে তাৎপর্যপূর্ণ (অর্থাৎ, p < 0.05) শক্তিশালী ধনাত্মক পরম্পরা সম্বন্ধ অর্থাৎ স্ট্রং পজিটিভ কোরিলেশনের সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসেব (পিয়ার্সনের r) ০.৯০২১ এবং উচ্চ সহসম্বন্ধ গুণাঙ্ক অর্থাৎ হাই কো-এফিশিয়েন্ট অফ ডিটারমিনেশনের মান (অর্থাৎ r2) ০.৮১৩৮।
এই ফল পরীক্ষা করবার জন্য আমি আরেকটা পরম্পরা সম্বন্ধ অর্থাৎ কোরিলেশনের সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসেব কষেছি। সেখানে অন্যান্য ভাষার শতকরা হারের সঙ্গে আমি স্বাধীন চল (ইন্ডিপেন্ডেন্ট ভ্যারিয়েবল) হিসেবে নিয়েছি ওই ১২-টা রাজ্যেরই গ্রামীন জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার। সাধারণত ধরে নেওয়া যায়, সরকারী বা রাজ্যের প্রধান ভাষাগুলো সাধারণত রাজ্যের উন্নয়নমূলক নীতির সঙ্গে ওতপ্রোত এবং মূলত শহরকেন্দ্রিক। ভারতীয় ভাষা বৈচিত্র্যকে দেখা হয় নানা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে। দৃষ্টান্ত: দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার অংশ হিসেবে বলা হয় ভারতবর্ষ বহুমাত্রিক সমাজ দিয়ে গড়া, যেখানে ভাষীর পরিচয় ভাষা ব্যবহারকারী হিসেবে বিশ্বজনীনভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। সেই কারণে তথাকথিক ভাষা-সীমানাগুলো ধোয়াশাচ্ছন্ন।