এ বছরের গরমকাল পৃথিবীতে রেকর্ড করা সবচেয়ে উষ্ণতম ছিল এবং ২০২৩ সবচেয়ে উষ্ণ বছর হতে চলেছে৷ উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ এবং এশিয়া জুড়ে তাপপ্রবাহ মানুষের স্বাস্থ্যকে হুমকির মুখে ফেলেছে। কানাডা সর্বকালের সবচেয়ে খারাপ দাবানলের মুখোমুখি হয়েছে এবং অগ্নিশিখা মাউয়ের লাহাইনা শহরকে ধ্বংস করে দিয়েছে। অন্যদিকে লস এঞ্জেলেস বিধ্বংসী ঝড়ের মুখোমুখি হয়েছে আবার লিবিয়ায় বৃষ্টিপাতের কারণে প্রবল বন্যায় হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে এবং নিখোঁজ হয়েছে। এই চরম আবহাওয়া একটি সতর্কতার সংকেত দেয় যে আমরা জলবায়ু সংকটের মধ্যে বাস করছি, এবং আমাদের অবিলম্বে কিছু করা উচিত।
জলবায়ু পরিবর্তনের পিছনে প্রধান অপরাধী হল জীবাশ্ম জ্বালানী থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমণ, এবং বিজ্ঞানীদের মতে এই নির্গমণে অবশ্যই লাগাম দিতে হবে৷ কিন্তু আরেকটি গ্রিনহাউস গ্যাস বিজ্ঞানীদের ভাবাচ্ছে: মিথেন৷ স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানী এবং গ্লোবাল কার্বন প্রকল্পের আধিকারিক রব জ্যাকসন বলেছেন, আগামী কয়েক দশক ধরে বিশ্বের উষ্ণতা হ্রাস করতে আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার হল মিথেন। এর কারণ হল বায়ুমণ্ডলে মিথেন তুলনামূলকভাবে স্বল্পস্থায়ী, বলা যায় প্রায় ১২ বছর এর স্থায়ীত্ব, যখনে CO2 শত শত বছর ধরে থাকতে পারে। তাছাড়াও মিথেন আরও শক্তিশালী। নির্গত হওয়ার ২০ বছরের সময়কালে, মিথেন CO2 এর তুলনায় ৮০ গুণেরও বেশি বায়ুমণ্ডলকে উষ্ণ করতে পারে।
ইতিমধ্যেই আমাদের মিথেন নির্গমন কমানোর কিছু কৌশল রয়েছে যেমন প্রাকৃতিক গ্যাস যার প্রধান উপাদান মিথেন তার নির্গমণ নিয়ন্ত্রণ করা, খননের কাজে যে মিথেন উৎপন্ন হয় তা নিয়ন্ত্রণ করা, মাংস ও দুগ্ধজাত খাবার কম খাওয়া কারণ গোরু থেকে প্রচুর মিথেন উৎপন্ন হয় এবং পরিবহন ব্যবস্থা ও যন্ত্রপাতির বিদ্যুতায়ন। গবেষণায় দেখা গেছে এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হলে আগামী দশকে বিশ্ব উষ্ণায়ন ৩০% অবধি কম হতে পারে। কিন্তু গবেষকদের মতে আমাদের আরও বেশি কিছু করতে হবে। বেশ কিছু মিথেন উত্স নির্মূল করা কঠিন হবে, যদিও তা অসম্ভব নয়। এর মধ্যে কিছু মানব-সৃষ্ট নির্গমন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যেমন ধান চাষ ও গবাদি পশুর দ্বারা উত্পাদিত মিথেন। বিশ্ব উষ্ণ হওয়ার সাথে সাথে কিছু প্রাকৃতিক উত্স আরও মিথেন নিঃসরণ করতে শুরু করেছে। গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলাভূমিগুলো ইতিমধ্যেই বায়ুমণ্ডলে আরও বেশি গ্যাস ছড়িয়ে দিচ্ছে, আবার আর্কটিকের দ্রুত উষ্ণায়ন পারমাফ্রস্টকে মিথেন তৈরির জীবাণুর একটি উৎকৃষ্ট স্থানে পরিণত করতে পারে এবং বর্তমানে হিমায়িত মাটিতে সঞ্চিত মিথেন বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পরতে পারে। তাই বিজ্ঞানীরা বাতাস থেকে সরাসরি মিথেন অপসারণের উপায় তৈরি করতে চান। বর্তমানে বায়ুমণ্ডলে তিন বিলিয়ন মেট্রিক টন বেশি মিথেন বিদ্যমান। জ্যাকসন বলেছেন যে অতিরিক্ত মিথেন অপসারণ করলে আমাদের পৃথিবী ০.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস শীতল হবে। বায়ুমণ্ডলে যেখানে সূর্যালোক এবং উচ্চ প্রতিক্রিয়াশীল হাইড্রক্সিল র্যাডিকেল প্রচুর পরিমাণে থাকে সেখানে মিথেন সহজেই ভেঙে যায়। মিথেনের শক্তিশালী উষ্ণায়ন শক্তি সত্ত্বেও, এটি বায়ুমণ্ডলে কম ঘনত্বে উপস্থিত। প্রতি ১ মিলিয়ন বায়ুর অণুর মধ্যে মাত্র ২ টি মিথেন রয়েছে যেখানে প্রতি ১ মিলিয়ন বায়ুর অণুর মধ্যে প্রায় ৪০০টি CO2 উপস্থিত। সুতরাং এটি সংরক্ষণ করার জন্য পর্যাপ্ত মিথেন একত্রিত করে এটিকে অন্য কিছুতে রূপান্তর করা চ্যালেঞ্জিং। প্রকৃতিতে উপস্থিত রসায়্নবিদরা কিন্তু এই চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতেও মিথেন গ্রহণ করতে এবং রূপান্তর করতে পারে। মিথেনোট্রফ নামক এক ধরনের জীবাণু মিথেন গ্রহণ করার জন্য এক ধরনের এনজাইম ব্যবহার করে। সারা বিশ্বব্যাপী মাটিতে বসবাসকারী মিথেনোট্রফ প্রতি বছর প্রায় ৩০ মিলিয়ন মেট্রিক টন মিথেন গ্রহণ করতে সক্ষম। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি অনুসারে, ২০২২ সালে মানুষের ক্রিয়াকলাপ বায়ুমণ্ডলে প্রায় ৩৫০ মিলিয়ন টন মিথেন পাম্প করেছে। বর্তমানে মাইক্রোবায়োলজিস্টরা জানতে চান যে এই ব্যাকটেরিয়াগুলো আরও দ্রুত মিথেন গ্রহণ করতে সক্ষম কিনা। অন্যান্য বিজ্ঞানীরা মিথেন-ধ্বংসকারী রাসায়নিক চুল্লি মিথেন উত্সের কাছাকাছি রাখার চেষ্টা করছেন। এই চুল্লিগুলো সাধারণত একটি অনুঘটক ব্যবহার করে রাসায়নিক বিক্রিয়াকে দ্রুততর করে যা মিথেনকে কম গ্রহ-উষ্ণায়নকারী অণুতে রূপান্তরিত করে।
ন্যাশনাল একাডেমি গ্রুপের লক্ষ্য আগামী গ্রীষ্মের মধ্যে মিথেন অপসারণ প্রযুক্তির গবেষণার অগ্রাধিকার সম্পর্কে সুপারিশ করা। এর জন্য সম্ভবত বিভিন্ন প্রযুক্তির একটি পোর্টফোলিও প্রয়োজন হবে কারণ গবাদি পশু যেখানে থাকে সেখানে যে পদ্ধতি কাজ করবে তা একটি বর্জ্য জল শোধনাগারে কাজ নাও করতে পারে।